headline

Search This Blog

adonion

হিন্দু ধর্ম ব্লগ



হিন্দু ধর্ম -৩

হিন্দু ধর্ম একটি প্রাচীন ধর্ম। এ ধর্মে দেব-দেবীর বিশ্বাস যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে খাঁটি একেশ্বরবাদী (Pare Monism) ধ্যান ধারণা। কিন্তু সংস্কৃতিগতভাবে যেহেতু বেশিরভাগ হিন্দুই দেব-দেবী পূজা করে থাকে সেহেতু বাহ্যিকভাবে বিশেষতঃ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই মনে করে থাকেন এটি বহু ঈশ্বরবাদী ধর্ম। এই প্রসঙ্গে বিশিষ্ট দার্শনিক ও সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স মুলার এর একটি মন্তব্য স্মর্তব্য। তিনি বলেছেন আসলে বেদের যে দেবতাতত্ত্ব তাকে বহু ঈশ্বরবাদ(Polytheism ) বলে আখ্যায়িত না করে এক পরম সত্তায় বহু দেবতার মিলন Henetheism বলাই ভালো। এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধে ঈশ্বরবাদ নিয়ে আলোচনা করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। তবুও প্রসঙ্গক্রমে দু'চারটি কথা বলা। কারণ ধর্মের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ঈশ্বরকে সন্ত্তষ্টি বিধানের নিমিত্তে বিভিন্ন রকমের বিধি-বিধান পালন করা এবং বিবিধ প্রকারের পাপাচার থেকে বিরত থাকাই মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। হিন্দুধর্ম হতে ঈশ্বর লাভের অসংখ্য পথ রয়েছে। এর মধ্যে একাগ্রচিত্তে যে কোন একটি পন্থায় ঈশ্বারোপাসনা উত্তম।
শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায় উল্লেখিত পন্থাগুলোর মধ্যে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ এবং ভক্তিযোগ অন্যতম। এখানে আমরা কর্মযোগ সম্পর্কে কিছু কথা বলবো। শ্রীমদ্ভগবৎ গীতায় বলা হয়েছে জীবমাত্রই কর্মের অধীন। কোনও জীবই কর্ম ভিন্ন বাঁচতে পারে না। এর মানে খাওয়া, ঘুমানো, কথা বলা, হাসি, কান্না, বসে থাকা, শুয়ে থাকা ইত্যাদি সব কিছুই কর্ম। যেহেতু যার প্রাণ আছে, সেই কোন না কোন কর্মের অধীন; সেহেতু মানুষের উচিৎ সর্বসময়ই সৎকর্মের প্রতি অনুরাগী হওয়া এবং নিয়ত নিরাসক্তভাবে কর্ম করাই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ কর্ম। এক নিস্কাম কর্ম বলে। এছাড়া আরও একটি কর্ম আছে তাকে সকাম কর্ম বলে। এই কর্মের ভেতর কামনা-বাসনা যুক্ত থাকে। এত জীব মুক্ত হতে পারে না, বরং বদ্ধজীবে রূপান্তর হয়। ফলে সে মোক্ষলাভ না করে কর্মানুসারে কামনা বাসনার বশবর্তী হয়ে এই পৃথিবীতে বারংবার জন্মলাভ করে কর্মানুসারে কামান বাসনার বশবর্তী হয়ে এই পৃথিবীতে বারংবার জন্মলাভ করে কর্মানুসারে ফল ভোগ করতে থাকে। তবে হিন্দু ধর্ম মতে মানুষ স্বর্গে যাক, আর নরকেই যাক কর্মফল অনুসারে সে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতে পারে। কর্মফল ভোগ শেষ হলে সে পুনরায় পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এবং এখানেই তাকে পুনরায় পরীক্ষা দিতে হয়। ঈশ্বর তার সকল কর্মেরই অত্যন্ত সুক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হিসাবে সংরক্ষণ করেন এবং এই কর্মফল অনুসারে তাকে পুরস্কার কিংবা শাস্তি দিয়ে থাকেন। একটা পাপাত্মা প্রায় ৮৪ লক্ষ-যৌনী ঘুরে আসার পর মনুষ্যরূপ লাভ করে। তার মানে প্রতিটি প্রাণী এবং উদ্ভিদও কর্মফল অনুসারেই জন্ম-মৃত্যুর অধীন। এটি একটি চক্র। এই চক্র বুঝতে হলে কাল মহাকাল (Time ) সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। কাল হচ্ছে সকল কর্মের আধার। আমরা যেমন পৃথিবী ছাড়া অবস্থান করতে পারি না, তেমনি কাল ছাড়া কোনও কর্ম সম্পন্ন করতে পারি না। এই কালের কোন শুরু নেই, শেষ নেই। কাল হচ্ছে অনন্ত এবং একমুখী One dimensional ।
এই জগৎ এবং জাগতিক সকল প্রাণী এবং বস্তু জগৎ সৃষ্টি, পালন তথা সংরক্ষণ ও সংহার করা, আবার পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি, সংরক্ষণ এবং সংহার করা এটি ঈশ্বর বা পরব্রহ্মের একটি লীলা খেলা। তবে এই চক্র থেকে সচেতন জীব তথা মানুষ মুক্তি পেতে পারে; যাকে হিন্দু ধর্মে মোক্ষ বলা হয়। এর জন্য প্রয়োজন মানুষকে নিস্কাম কর্ম সম্পাদক করা অর্থাৎ ফলের আশা না করে, কোন কামনা-বাসনা বশবর্তী না হয়ে কর্মের খাতিরে কর্ম করা এবং তা অবশ্যই সৎকর্ম হতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ঈশ্বরে শরণাগতি থাকতে হবে। তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর নিকট কৃতজ্ঞ থাকা, তাঁর নিকট সর্বাবস্থায় সন্তোষ প্রকাশ করা জীবমাত্রই একান্ত কর্তব্য। ঈশ্বর তার চেয়ে বেশি কিছু চান না। এ ক্ষেত্রে তিনি দয়াময় তবে জীবমাত্রই যেহেতু কর্মের অধীন, সেহেতু কর্মফল তার অদৃষ্ট এবং তা ভোগ করতেই হবে। তাই শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে জ্ঞানীরা বহু দেব-দেবীর ভজনা ছেড়ে এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের স্মরণ নিয়ে থাকে এবং নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন করে। পাশ্চাত্যে এই তত্ত্বটি জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট 'কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য' Duty for duty Sake বলে প্রচার করেছেন।  কোথায় কখন, কিভাবে দুর্গা পুজার সূচনা হয় তা সঠিক ভবে বলা মুশকিল। প্রাচীন কাল থেকেই প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে পাঞ্জাবের হরপ্পা ও সিন্ধুর মহেঞ্জোদারোতে দেবীর পূজা হতো। শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং দেবীর পূজা করেছেন। ইতিহাস থেকে যতটুকু জানা যায় তৎকালীন শ্রীহট্ট(বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট) এর রাজা গনেশ পঞ্চদশ শতকে প্রথম মূর্তিতে দূর্গা পূজা করেন। ষোড়শ শতকে রাজশাহী অঞ্চলের রাজা কংশনারায়ন দুর্গা পূজা করেন। অষ্টাদশ শতকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র দুর্গা পূজা করেন।

        পূর্বে রাজা, জমিদার, মহাজন তথা বিত্তবানরা আতীয়স্বজন সমন্বয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ধুমধাম করে প্রতিযোগিতার মনোভাব নিয়ে দুর্গাপূজা করতেন। সাধারন মানুষকে তাদের প্রতিযোগিতা দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে রাজা নেই, জমিদার ও নেই। কিন্তু শ্রী শ্রী মা দুর্গার পূজা প্রতি বৎসরই হয়। এখন মা এর পূজা সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে। এখন ধনী-গরিব-গোত্র-বর্ণ সবাই একসাথে প্রার্থনা করে মায়ের চরনে।




-দুর্গা পূজার প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু করেছে শিল্পীরা

          হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হতে আরো প্রায় দু মাস বাকি থাকলেও শুরু হয়ে গেছে প্রতিমা তৈরির কাজ । পূজা মণ্ডপগুলোতে এখন প্রতিমা শিল্পীরা ব্যস্ত মণ্ডপ তৈরির কাজে। শান্তি, সংহতি, সম্প্রিতি এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে সারা দুনিয়ার মংগল কামনায় শারদ মাসে দেবী দুর্গা লোকালয়ে আসেন।
যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তি রুপেন সংস্থিতা।
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ





         দেবী দুর্গা (সংস্কৃত: दुर्गा, বুৎপত্তিগত অর্থ: যিনি দুর্গ অর্থাৎ সঙ্কট হতে ত্রাণ করেন; পুরাণ অনুযায়ী: যিনি দুর্গ নামক অসুর বিনাশ করেছেন) পরমা প্রকৃতি ও সৃষ্টির আদি কারণ।  দুর্গা সাধারণত দশভূজা, দশপ্রহরণধারিনী ও সিংহবাহিনী। হিন্দু পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে তিনি শিবের স্ত্রী পার্বতী, কার্তিক ও গণেশের জননী, এবং কালীর অন্যরূপ। পুরাণ অনুসারে তিনি তিনবার মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন।

           দুর্গার আরাধনা বাংলা, অসম এবং বিহারের কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচলিত। ভারতের অন্যত্র দুর্গাপূজা নবরাত্র উৎসব রূপে উদযাপিত হয়। সম্ভবত খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় দুর্গোৎসব প্রবর্তিত হয়। বাংলায় দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিতা হলেও তাঁর কাত্যায়নী মূর্তিরই পূজা হয়। মহিষমর্দিনীর প্রতিমা বর্তমানে তামিলনাড়ুতে প্রচলিত।

          দুর্গা মূলত শক্তি দেবী। বৈদিক সাহিত্যে দুর্গার উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে দুর্গার বিশেষ আলোচনা ও পূজাবিধি তন্ত্র ও পুরাণেই প্রচলিত। যেসকল পুরাণ ও উপপুরাণে দুর্গা সংক্রান্ত আলোচনা রয়েছে সেগুলি হল: মৎস্যপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও দেবী-ভাগবত। তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামেও পূজিতা হন। বছরে দুইবার দুর্গোৎসবের প্রথা রয়েছে – আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয়া এবং চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা।
কাঠামো পূজো দিয়ে শুরু দুর্গা পূজা



           

রথযাত্রার দিনই কাঠামো পুজোর মাধ্যমে  কার্যত সূচনা হয়ে গিয়েছে দুর্গোত্‍সবের. বেশির ভাগ বাড়িতেই পুজোর কাঠামো পুজো হয়ে গিয়েছে ওই দিন

            মহাশক্তি শ্রীদুর্গা দেহ দুর্গের মূল শক্তি। মানুষের দেহ একটি দুর্গ বিশেষ। পঞ্চভূতে নির্মিত যথা-ক্ষিতি, অপ,তেজ,মরুদ, ব্যোম। দেহের মূলশক্তি প্রাণশক্তিকে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ , মাৎসর্য-এ ষড়রিপু আক্রমন করে।

            দুর্গা দেহদুর্গের মহাশক্তি। সাধক সাধনাকালে সেই শক্তিকে জাগ্রত করেন। সেই শক্তি যখন জাগ্রত হয় তখন দেহস্থিত রিপুসমূহ তাকে পরাজিত করে বশীভূত করার জন্য উদ্যোগি হয়। সে সময় দেবশক্তি ও রিপু তথা আসুরিক শক্তির মধ্যে বাঁধে সংঘর্ষ। সেই অন্তর জগতের সংঘর্ষের একটি প্রতীকি রুপ শ্রী শ্রী চন্ডির মাধ্যমে রুপায়িত হয়েছে।

          
 আধ্যাত্মিক ভাবনা দুর্গা কাঠামোতে অন্তর্নিহিত। দুর্গার দশহাত দশদিক রক্ষা করার প্রতীক, দশপ্রহরণ এক এক দেবতার সাধনলব্দ বিভূতি। দেবী ত্রিভঙ্গা-ত্রিগুণাত্মিকাশক্তির প্রতীক অর্থাৎ সত্ব;রজঃ তমগুণের প্রতীক। দেবী ত্রিনয়নী-একটি নয়ন চন্দ্রস্বরুপ, একটি সূর্যস্বরুপ এবং তৃতীয়টি অগ্নিস্বরুপ। তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই নিয়ন্ত্রিত হয় ত্রিকাল। দেবী সিংহবাহনা-তামসিক পশুশক্তির অধিপতি পশুরাজ সিংহ। মহিষাসুর-দেহস্থ প্রবল রিপুর প্রতীক। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এর ঘনীভূত মূর্তি মহিষাসুর। শিব-সর্বপুরি অধিষ্ঠিত শিব মঙ্গল ও স্থিরত্বের প্রতীক। দেবীর ডানপার্শ্বে উপরে লক্ষ্মী-ধনশক্তি বা বৈশ্যশক্তির, গণেশ-ধনশক্তির বা শূদ্রশক্তির, সরস্বতী-জ্ঞানশক্তি বা ব্রহ্মণ্যশক্তির, কার্তিক ক্ষত্রিয়শক্তির প্রতীক। শক্তিসমূহ অনুভূতির বিষয় অনুভূতির আকার নেই। আকার দেয়া হয়েছে মানুষের বোঝার সুবিধার জন্য। সকল শক্তিই ব্রহ্মশক্তি। সাধকের হিতার্থে ব্রহ্মের নানান রূপ কল্পনা ।

  ষোলোয়ানা বাঙালিয়ানা      
          বাঙ্গালীদের সকল আবেগের সমষ্টি দুর্গা পূজা। তার সংস্কৃতি, ভালোবাসা, একত্র থাকার যে উষ্ণতা, উৎসবের যে আনন্দ সবই আছে এতে। প্যান্ডেল তৈরীতে একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে তারা অনেক আনন্দ পান।


-প্রতিমা গড়ার কাজ চলছে কুমোরটুলিতে

         এই উৎসব মহাকাব্য রামায়ন অনুসারে শুরু হয়েছে সেই সময় থেকে যখন রাম তাঁর স্ত্রী সিতাকে অপহরণকারী রাবণের কাছ থেকে উদ্ধারের জন্য যুদ্ধে যাওয়ার আগে অভিবাদন জানান দুর্গা দেবীকে। যেহেতু সময়ের বাইরে দেবীর পুজা করা হয়েছিল, রামের করা দুর্গা পুজাকে ‘অকালবোধন’ বলা হয় (সময়ের আগে প্রার্থনা)।

         রামের উদাহরণ অনুসারে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ভেদে দুর্গা পূজা এখন উদযাপিত হয় ৫ দিন (দুর্গা পূজা)- ১০ দিন ধরে (নবরাত্রি- যেখানে ৯ শক্তির পূজা হয়) ।


          দুর্গা পূজার পেছনের মূল গল্প একই থাকলেও, দুর্গা পূজাতে (বা পূজো যেমন বাংলায় বলা হয়) বাঙ্গালীদের একটু স্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তিগত ছোঁয়া আছে । বিশ্বাস করা হয় যে দূর্গা বাংলার মেয়ে আর উৎসবের এই ৫ দিনে সে তার বাপের বাড়িতে ৪ সন্তান (গনেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী ও কার্তিক) আর কাছের দুই জন বন্ধু সহ বেড়াতে আসেন। তার স্বামী শিব সাধারণত: এমন সময়ে তাঁর সাথে আসেন না। তিনি স্বর্গে থেকে যান, আর তার স্ত্রী ও সন্তানদের পৃথিবীতে এসে বাঙ্গালী আত্মীয়দের কাছ থেকে সব আদর গ্রহণ করতে দেন।                                                                    
বিদ্যার দেবী স্বরস্বতী

হিন্দুধর্মে দেব-দেবীদের মাঝে দেবী স্বরস্বতী এক সুউচ্চ আসনে অধিষ্টিত হয়ে আছেন সেই বৈদিক যুগ থেকে।বেদ-হিন্দুদের প্রাচীন তম ধর্মগ্রন্থে দেবী স্বরস্বতীর কথা উল্লেখ আছে। ঋগবেদে স্বরস্বতীর নাম পাওয়া যায় নদী হিসেবে।

বস্তুত প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি প্রধান নদী হল-স্বরস্বতী, গন্গা ও যমুনা। এই তিন নদীর মাঝে গন্গা এখনো বহমান ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে গন্গা ও পদ্মা নাম নিয়ে।
স্বরস্বতীকে {सरस्वती} বলা হয় বিদ্যা ও সংগীতের দেবী।

স্বরস্বতীকে বেদের মাতা হিসেবে ও স্বিকৃতী দেয়া হয়েছে বেদে।
ভাষাগত দিক বিচার করলে স্বরস্বতী নামটি এসেছে 'স্বরস' অর্থাথ বহমান[flowing] এবং ওয়াতি বা রমনী[woman] থেকে।যার অর্থ দাঁড়ায় বহমান রমনী বা নদী যার গতিময়তা নদীর মতো এবং সৌন্দর্য রমনীর মতো।দেবী বৌধ্বধর্মে ভগবান বুধ্বের জ্ঞানপ্রদায়ীনি রুপে ও পুজিত হন।বার্মায় দেবী বুধ্বরার্থী[Thurathadi ] বা থিপিটাকা[Tipitaka /θùja̰ðədì ] নামে , চিনাদের মাঝে বিয়ানচাইতান[Biàncáitiān/(辯才天),] নামে, বর্মিজ দের মাঝে সুরসোয়াধি[Surasawadee /(สุรัสวดี)] নামে এবং জাপানী দের মাঝে বেনজেইতেন[Benzaiten (弁才天/弁財天)] নামে পরিচিতা।
বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর ও দক্ষিনাংশে দেবী দুর্গার কন্যা হিসেবে দেবীকে সবাই পুজা করে আসছে বহু বছর ধরে।

প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে স্বর্গে তিন দেবী যমুনা,গন্গা ও স্বরস্বতী নিজেদের মাঝে বিবাদের জড়িয়ে পড়েন এবং নিজেরা নিজেদের অভিশাপ দেন যে সবাইকেই পৃথিবীর বুকে বহমান নদী হিসেবে প্রবাহিত হতে হবে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পরে সবাই ফিরে আসবেন স্বর্গের বুকে।আর এভাবেই দেবী স্বরস্বতীর কথা জানা যায় ঋগবেদ থেকে।
বেদে বলা হয়েছে- দেবী হলেন বিদ্যা, জ্ঞান , সংগীত এবং সৃষ্টিশীলতার দেবী।সংখ্যা পুরান এ বলা হয়েছে দেবী স্বরস্বতী হলেন দেবতা শিবের কণ্যা এবং দেবতা গনেশের ভগ্নি।পদ্মপুরান এর উত্তর কান্ডে রয়েছে-
সকলকিছুর কেন্দ্রে রয়েছে অগ্নি-সুর্য ও চন্দ্র যাদের থেকে উৎপত্তি হয়েছে কূর্ম অবতার ও অনন্ত শেষ এবং গেরুদা যারা থাকবেন এক অনন্ত পরিবেশে যা ধারণ করবে সকল বেদ কে এবং যা পরিচিত হবে স্মৃতি শাস্ত্র হিসেবে যার বুৎপত্তি দেবী স্বরস্বতীতে- [পদ্মপুরান - উত্তর কান্ড-২৫৬.২৩।

বেদান্ত মতে দেবী স্বরস্বতী হলেন সকল শক্তির উৎস এবং সকল মঙ্গলের ধারক ও বাহক।দেবী মহাত্ম্যে দেবী স্বরস্বতীকে মনে করা হয় মহাকালি,মহালক্ষী ও মহাস্বরস্বতীর এক ত্রিরুপ যার আটটি হাত এবং যিনি মহামন্গলময়।দেবীমহাত্ম্যের দৈনশ্লোকে বলা হয়েছে-
তিনি ধারণ করেন শংখ,ত্রিশুল,কোচ,তীর,ধনুক,বল্লম ও শুল এবং জ্বলতে থাকেন জোত্যিময় প্রভার মতো বাসন্তী আকাশে-জন্ম হয়েছে তাঁর মহাদেবীর দেহ থেকে যার স্থান ত্রিশব্দে হে মহাস্বরস্বতী আমি তোমাকে হোম দিই শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দৈত্যকে হ্ত্যা করার মানসে।

দেবী স্বরস্বতীর প্রতিমায় দেখা যায় দেবী পরিধান করেন শ্বেতশুভ্র কাপড়-যার অর্থ দেবী সত্য ও সুন্দরের প্রতীক।দেবীর চার হাত।দেবীর এক হাতে বীণা -বীণা হলা একপ্রকার বাদ্যযন্ত্র যেটা সংগীত সৃষ্টির কাজে ব্যবহৃত হয়।দেবীর এই বাদ্যযন্ত্র সংগীতের প্রতি দেবীর মহিমা প্রকাশ করে।দেবীর আরেক হাতে পুস্তক বা বই।দেবীর চারটি হাত মানুষের চারটি গুন এর প্রকাশ যা মানুযকে ধারণ করতে হয়- মন, জ্ঞান,প্রজ্ঞা ও আমিত্ব।কেউ কেউ মনে করেন দেবীর চার হাত চার বেদ ও চারটি যুগের প্রকাশ।
দেবী বসে আছেন এক হাসের পিঠে-অর্থাৎ দেবীর বাহন হাঁস। এখানে হাঁস একটি রুপক মাত্র। হাঁস একটি গৃহপালিত পাখিবিশেষ যা সাধারণত বাসগৃহের জলাধার গুলোতে থাকে। হাঁস যতই পানিতে সাঁতার কাটুক পানি থেকে উঠে এলে হাঁসের শরীরে পানির কোন লেশমাত্র থাকেনা।দেবীর বাহন হাঁস আমাদের এই সংসারের পাপ পংকিলতার মাঝে থেকে ও জ্ঞানী হতে শিক্ষা দিতেই হাঁস কে বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
হাঁসের আরো একটা গুন হল দুধ আর পানির মিশ্রণ হাঁসকে খেতে দিলে হাঁস ওখান থেকে শুধু দুধটাকেই আলাদা করে খেতে পারে।এই উপমা থেকে দেবী শিক্ষা দেন যেন ভাল ও মন্দের মাঝ থেকে আমরা ভাল ও সুন্দর কে আমরা বেছে নিতে পারি।

চিনে দেবী স্বরস্বতীর প্রতিমা

বার্মা সংস্কৃতিতে দেবী স্বরস্বতী বই হাতে পাখিকে বাহন করেন

উত্তর ভারতের ব্রজেশ্বরী মন্দিরের দেবী মহাস্বরস্বতী

প্রতিবছর মাঘমাসের পন্চমী তিথিতে দেবী স্বরস্বতীর পুজা অনুষ্টিত হয়।বাংলার ঘরে ঘরে বিদ্যার্থীরা দেবীকে পুজা করেন বিদ্যা ও জ্ঞান লাভের আশায়।আশা করি দেবীর কৃপায় বাংলার ঘরে ঘরে বিচরণ করবে শুভ্র ও সুন্দর জ্ঞান- সুখ ও শান্তিতে ভরে উঠবে প্রতিটি মানুষ।
আরো জানতে এখানে ক্লিক করুন                                                                                   সীতার পাহাড় হতে পারে এক টি সুন্দর তীর্থ ক্ষেত্র কাপ্তাই সীতার পাহাড় নামে একটি স্থান আছে। কর্ণফুলী নদীর পাশে দাড়িয়ে আছে সীতার পাহাড় । খুব সুন্দর জায়গা। গত কয়েক বছর আগে এক ব্রহ্মচারি বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে মা সীতার মন্দির করে। আমি গিয়ে ছিলাম সে মন্দিরে। ব্রহ্মচারির সাথে কথা বলে জানতে পারলাম এ খানে মা সীতার মন্দির সহ বিভিন্ন দেব-দেবির মন্দির করার ইছা তার আছে। কিন্তু তার একা পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তবে সরকার থেকে কিছু অনুদান পেলে তিনি কাজ শুরু করতে পারবেন বলে আসা করছেন। যদি সরকার একটু এ সীতার পাহাড়ের দিকে নজর দেয় তাহলে এ সীতার পাহাড় বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম একটা তীর্থ ক্ষেত্র হবে বলে আমি আশা করছি। সনাতন ধর্মের সকলে একটু নজর দিলে হয়তো খুব তাড়াতাড়ি আমরা আমাদের এ বাংলাদেশে একটি ভক্তিময় তীর্থ ক্ষেত্র পাব। তাই এই বিষয়ে সকল পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি.........।নমস্কার্‌।

ডাউনলোড করুন নারদ সংহিতা, ভক্তিপথ নিয়ে নারদের সংক্ষিপ্ত বাণীএক মুঠো লাল গোলাপ....

ভক্তিযোগ বর্তমান হিন্দু ধর্মে অন্যতম একটি পথ। বর্তমানে মানুষের শরীরে আগের মত শক্তি ও তেজ নাই যার দ্বারা সহজে সাধনা করা যায়। তাই শুধু ভক্তির জোড়েই সাধনা করা হয়। কিন্তু এই ভক্তি কেমন হবে? এটা কি সকালে বিকালে নমোঃ নমঃ বললেই হবে নাকি আরও কিছু??
ভক্তিতে সেরা যদি কারো নাম নিতে হয়,তবে প্রথমেই আসে দেবর্ষি নারদ। ব্রক্ষ্মার পুত্র নারদ এমনিতে কলহপ্রিয় হলেও শুধুমাত্র ভক্তির কারণেই উনি সবার প্রিয়। সর্বত্র উনার বিরাজতা।
 

দেবর্ষির ভক্তি সম্বন্ধে কিছু বাণী নিয়ে একটি বই নারদ সংহিতা। যদিও এর আকার অনেক ছোট কিন্তু ভক্তির মূল কথাগুলো এখানে অনেক সহজে তুলে ধরা হয়েছে। নিচে কিছু উদাহরণ দিচ্ছি,
নারদস্ত্ত তদর্পিতাখিলাচারতা তদ্বিস্মরণে পরমব্যাকুলতেতি।। ১৯।।
অনুবাদ, দেবর্ষি নারদ বলেন, "ঈশ্বরের কাছে সকল কর্ম সমর্পণ এবং মুহুর্ত কালের জন্যেও ঈশ্বর বিস্মরণ হলে অত্যন্ত ব্যাকুল হওয়াকেই ভক্তি বলে"।
তদ্বিহীনং জারাণামিব ।।২৩।।
অনুবাদ, ঈশ্বরজ্ঞান ব্যাতীত প্রেমভক্তি ব্যভিচারী প্রেমের সমান।
নাস্ত্যেব তস্মিন্‌স্তৎ সুখসুখিত্বম্‌ ।। ২৪।।
অনুবাদ, (প্রিয়তমের) এইরুপ ব্যভিচারী প্রেমের সুখে সুখী হওয়া যায় না।
এমন ভক্তি নিয়ে অনেক কথার আলোচনা করা হয়েছে এই বই তে। বইটি পিডিএফ আকারে আছে এবং সাইজ মাত্র 212KB। তাই এখনই সংগ্রহ করুন। আর যাচাই করুন ধর্মে প্রেম ভক্তিকে কিরুপে দেখা হয়েছে আর এখন আমরা তার কি বিকৃতি ঘটাচ্ছি। *** বইটির সকল কৃতিত্ব প্রকাশক ও এর প্রথম প্রচারকের, অনেকদিন আগে পেয়েছিলাম তাই তাদের কোনো লিংক দিতে পারলামনা।ধন্যবাদসবাইকে       
কালীসময়ওশক্তিরদেবী

হিন্দু ধর্মে যে সকল দেব দেবী আমাদের পরিচিত তাদের মাঝে "দেবী কালী" অন্যতম।সংস্কৃতে "কালিকা" এবং বাংলায় "কালী" নামে পরিচিতা দেবীর মুর্তি কালো। "কালী" নামের অর্থ কালো। আবার কালো শব্দ টা এসেছে কাল বা সময় থেকে। তাই দেবী কালী কাল বা সময়ের দেবী- পরিবর্তনের দেবী।


পুরাতন সংস্কৃত গ্রন্থ শব্দকল্পদ্রুম মতে "কালী" নামটা এসেছে এই ভাবে-
कालः शिवः । तस्य पत्नीति - काली: কালী
এখানে আরো বলা হয়েছে ভগবান শিবের আরেকনাম কালা-আর তাঁর স্ত্রির নাম কালী।
আরেকটি নাম আছে "কালরত্রি" {কালো রাত}যার থেকে বিবর্তনের ফলে এসেছে "কালিকা" বা "কালী"।

"দেবী কালী"র নাম পাওয়া যায় বহু ধর্মগ্রন্থে- যার মাঝে "অর্থব বেদ" অন্যতম।

তবে প্রথম "কালী" নামটি উচ্চারিত হয় অর্থব বেদের "কথাগ্রহসুত্রে" ।এর পর "মুন্ডকউপনিষদে" কালী নামটা উচ্চারিত হয়েছে বারবার।
এরপর মহাভারতে ভিষ্মপর্বে দেবী কালীর পুজার কথা পাওয়া যায় পান্ডবদের বিজয় লাভের আকাংখায়।


মা কালীর অনেক রকম পুজার মাঝে তন্ত্রবিদ্যায় বা তন্ত্র বিদ্যার শাখাপ্রশাখায় কালীর পুজা করা বাধ্যতা মুলক-কারণ মা কালীর পুজা করার মাধ্যমেই তান্ত্রিকরা মন্ত্রশক্তির অধিকারী হতে পারেন বলে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে কথিত আছে।

পুরাণ মতে দেবী কালী হলেন মা মহামায়ার কালীকা শক্তি।দেবী মহামায়া অসুর দের অত্যাচারে অতিষ্ট দেব ও মানবকুলের কান্না আর আহাজারি সহ্য করতে না পেরে ক্রোধে ফেটে পড়েন। অত্যন্ত ক্রোধে র ফলে তাঁর শরীর থেকে জ্যোতি বের হতে থাকে এবং তিনি কালো রুপ ধারণ করেন।
এবং অসুর নিধনে খড়গ হাতে নেমে পড়েন মহা যুদ্দ্বে।যত তিনি হত্যা করতে থাকেন ততই তাঁর ক্রোধ বাড়তে থাকে।তখন তিনি মহাকালী রুপে খড়গ দিয়ে অসুরের মাথা কাটতে কাটতে নিজের শরীরে পরিধান করতে থাকেন।এভাবে অসুর নিধন করতে করতে মা পাগলীনি প্রায় হয়ে উঠলে
দেবতারা চিন্তিত হয়ে মহাদেবের কাছে আসেন কালী দেবীকে থামানোর উপায় খুঁজতে।
দেবতা শিব বহু ছলনা করেও দেবীকে থামাতে না পেরে পথের ধারে উঁচু গাছের রুপ নিয়ে পড়ে থাকেন।আর যেই দেবী সেই গাছের উপর পা রাখেন সাথে সাথে দেবাদিদেব মহাদেব নিজ রুপে আর্ভিভুত হন।আর দেবী নিজের স্বামীকে পায়ের নিচে দেখে জিহবায় কামড় দেন।এবং থেমে যায় তাঁর যুদ্ধ।তারপর থেকে দেবী কালীকে রুদ্রমুর্তিতে দেবতা শিবের বুকের উপর পা দেয়া অবস্থায় পুজা করা হয়ে আসছে।

আসলে দেবী কালী র যে মুর্তিতে পুজা করা হয় সেটা অনেকটা রুপক অর্থে।দেবীর গায়ের রং কালো-কালি বা কালো হল শক্তির রং-সময়ের রং-দেবী শক্তির আঁধার বুঝাতেই দেবী কালো-দেবী কোন বস্ত্র পরিধান করেন না কারণ শক্তিকে কোন কিছু দিয়ে ঢেকে রাখা যায়না-দেবী র চারটি হাত চারটি যুগ বা চারটি বিভাগ { ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ} কে নির্দেশ করে।

দেবীর এক হাতে খড়গ-যার মানে তিনি খড়গ বা খন্ডন করতে পারেন- এক হাতে কাটা মুন্ড যার মানে তিনি আমাদের খারাপ কাজের যে কোন রকম শাস্তি দিতে পারেন-উনার উপরের ডান হাত আর্শিবাদ ভংগীতে আছে অর্থাত মা তাঁর সন্তান দের অভয় দিচ্ছেন-আর নিচের হাতে কমন্ডুল যার মানে মা ধারন করছেন সকল প্রকার মায়া।
মায়ের তিনটি চোখ- তৃতীয় নয়ন দিয়ে মা আগুন ছিটিয়ে ধ্বংস করেন খারাপ কে-অশুভ কে।
মায়ের জি্হবা লাল আর তা বের করা। অনেকেই মনে করেন মা অসুর বা খারাপের রক্ত পান করেন-কিন্তু না তা সত্য নয়-মায়ের দাঁত সাদা-মা রক্ত পান করলে তার ও লাল থাকতো-এখানে লাল জিহবা তমোগুনের প্রতীক-আর সাদা দাঁত স্বত্ত গুনের প্রতীক-মানে মা স্বত্ত্ব গুন দিয়ে তমোগুন কে চেপে রেখেছেন- আমাদের বলেছেন যেন আমরা ভাল গুন দিয়ে খারাপ কে জয় করতে পারি।
মায়ের এক পা দেবতা শিবের উপর রাখা কারণ মা দেবতা শিবের হ্লাদিনি শক্তি বা হাস্যময়ী শক্তি- কালী ছাড়া কালা{শিবের} অচল-এটা ই বুঝাতে চেয়েছেন।

দেবী কালী কালে কালে বহুরুপে পুজিত হয়ে আসছেন-যাদের মাঝে আছে
-দক্ষিনা কালী
-ভদ্রা কালী
-কপালীনি
-ভৈরবী
-মাতন্গী
-মহাকালী প্রভৃতি।

যুগেযুগে বহু মনীষী মা কালীর আরাধনা করে সিদ্ধ হয়েছেন যাদের মাঝে শ্রী রামকৃষ্ণ-বামাক্ষেপা-অতুলপ্রসাদ-রামপ্রসাদ অন্যতম- এখনো রামপ্রসাদি আর বামাক্ষেপার রচিত গান শুনতে শুনতে মায়ের অমোঘ টানে হারিয়ে যার মন।                                                         
জয় মা কালী
                                      নিজেকেসৌভাগ্যবানমনেকরছি এই ব্লগ এ নিজেকে যুক্ত করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
আশা করি এই ব্লগ বাংলাদেশ তথা সারা পৃথিবীর হিন্দু ধর্মীয় জন সাধারনের কাছে পৌছে দেবে শান্তি ও ঐক্যের মহান বানী।
ধন্যবাদ সবাইকে।
   কিছু চমৎকার দেবমূর্তি এখন আপনাদের সাথে শেয়ার করবো কিছু চমৎকার দেব দেবীর মূর্তি। যেগুলো শিল্পমান বিচারে খুবই উন্নত মানের। আসুন দেখে নেই সেই দেবদেবীর মূর্তি গুলোর কিছু ছবি।

প্রথম মূর্তি টি হল গণপতি গনেশ এর। এখানে গণেশ ত্রিভঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন।



চতুর্ভুজ শ্রীহরি


মা মহামায়া


 দশভুজা রুপী দুর্গা


মা দুর্গা



শিবলিঙ্গ
শিবলিঙ্গ

নৃত্যরতা পার্বতী



দেবী মহাকালী

দেবাদিদেব মহাদেব



হরপার্বতী



দেবী মহামায়া

নৃত্যরতা দেবী কালী




দশভুজা দুর্গা


নৃত্যরতা গণেশ


নটরাজ শিব


কষ্টি পাথরের হর পারবতী

দেবী
দুর্গা
দুর্গা

হর পার্বতী



শ্রী হরি



শ্রী হরি

ধ্যান রত
শ্রী হরি

নৃত্যরত
শ্রী হরি

দেবী মহামায়া

শ্রী হরির কূর্ম অবতাররুপ

 বামন অবতার রুপী শ্রী হরি

আজ এ পর্যন্তই- ভাল থাকবেন।

হরে কৃষ্ণ।
ওঁ-প্রনব এর কিছু সুন্দর ডেক্সটপ ওয়াল পেপার নিন ওঁ বা প্রণব কে আমরা সবাই চিনি ও জানি-এবং এটা ও জানি যে এই প্রণব বা ওঁ শব্দটি এসেছে অ+উ+ম থেকে। এখানে অ- মানে ব্রহ্মা, উ- মানে বিষ্ণু, আর ম-তে মহেশ্বর। এই মহামন্ত্র ওঁ হ্ল সকল সৃষ্টি মুলের মুল স্বরূপ। তাই আদি কাল থেকে মুনিঋষি গন এই প্রণব ঊচ্চারন করেই তাঁদের সাধনা করতেন।
 আজ আমি নিয়ে এলাম ওঁ এর কিছু ডেক্সটপ ওয়ালপেপার নিয়ে। আশা করি এই ছবি গুলো আপনাদের ডেক্সটপের সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করবে এবং আপনাদের মনে এক সুখের পরশ বুলিয়ে দেবে অনায়াসে।







































ধন্যবাদ সবাইকে।
ভাল থাকবেন।
হরে কৃষ্ণ
                                                                                                     ভগবান শ্রী শ্রী কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম
সাবাশ বাংলাদেশে এটা আমার প্রথম পোস্ট big grin ।ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম নিয়েই শুরু করছি আমার যাত্রা happy
http://www.rongmohol.com/extensions/pic_man/img/upload/2223shohagh2011_1301889215_1-Loard_Krishna_20.jpg

জয় জয় গোবিন্দ গোপাল গদাধর।
কৃষ্ণচন্দ্র কর দয়া করুণাসাগর।।
জয় রাধে গোবিন্দু গোপাল বনমালী।
শ্রীরাধার প্রাণধন মুকন্দ মুরারি।।
হরিনাম বিনে রে গোবিন্দ নাম বিনে।
বিফলে মনুষ্য জন্ম যায় দিনে দিনে।।
দিন গেল মিছে কাজে রাত্রি গেল নিদ্রে।
না ভজিনু রাধাকৃষ্ণ চরণার বিন্দে।।
কৃষ্ণ ভজিবার তরে সংসারে আইনু।
মিছে মায়ায় বদ্ধ হ’য়ে বৃক্ষসম হৈনু।।
ফলরূপে পুত্র কন্যা ডাল ভাঙ্গি পড়ে।
কালরূপে সংসারেতে পক্ষী বাসা করে।।
যখন কৃষ্ণ জন্ম নিল দৈবকী উদরে।
মথুরাতে দেবগণ পুষ্পবৃষ্টি করে।।
বসুদেব রাখি এলো নন্দের মন্দিরে।
নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে দিনে বাড়ে।।
শ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন।১
যশোদা রাখিল নাম যাদু বাছাধন।।২
উপানন্দ নাম রাখে সুন্দর গোপাল।৩
ব্রজবালক নাম রাখে ঠাকুর রাখাল।।৪
সুবল রাখিল নাম ঠাকুর কানাই।৫
শ্রীদাম রাখিল নাম রাখাল রাজা ভাই।।৬
ননীচোরা নাম রাখে যতেক গোপিনী।৭
কালসোনা নাম রাখে রাধা-বিনোদিনী।।৮
কুজ্বা রাখিল নাম পতিত-পাবন হরি।৯
চন্দ্রাবলী নাম রাখে মোহন বংশীধারী।।১০
অনন্ত রাখিল নাম অন্ত না পাইয়া।১১
কৃষ্ণ নাম রাখেন গর্গ ধ্যানেতে জানিয়া।।১২
কন্বমুনি নাম রাখে দেব চক্রপাণী।১৩
বনমালী নাম রাখে বনের হরিণী।।১৪
গজহস্তী নাম রাখে শ্রীমধুসূদন।১৫
অজামিল নাম রাখে দেব নারায়ন।।১৬
পুরন্দর নাম রাখে দেব শ্রীগোবিন্দ।১৭
দ্রৌপদী রাখিল নাম দেব দীনবন্ধু।।১৮
সুদাম রাখিল নাম দারিদ্র-ভঞ্জন।১৯
ব্রজবাসী নাম রাখে ব্রজের জীবন।।২০
দর্পহারী নাম রাখে অর্জ্জুন সুধীর।২১
পশুপতি নাম রাখে গরুড় মহাবীর।।২২
যুধিষ্ঠির নাম রাখে দেব যদুবর।২৩
বিদুর রাখিল নাম কাঙ্গাল ঈশ্বর।।২৪
বাসুকি রাখিল নাম দেব-সৃষ্টি স্থিতি।২৫
ধ্রুবলোকে নাম রাখে ধ্রুবের সারথি।।২৬
নারদ রাখিল নাম ভক্ত প্রাণধন।২৭
ভীষ্মদেব নাম রাখে লক্ষ্মী-নারায়ণ।।২৮
সত্যভামা নাম রাখে সত্যের সারথি।২৯
জাম্বুবতী নাম রাখে দেব যোদ্ধাপতি।।৩০
বিশ্বামিত্র নাম রাখে সংসারের সার।৩১
অহল্যা রাখিল নাম পাষাণ-উদ্ধার।।৩২
ভৃগুমুনি নাম রাখে জগতের হরি।৩৩
পঞ্চমুখে রাম নাম গান ত্রিপুরারি।।৩৪
কুঞ্জকেশী নাম রাখে বলী সদাচারী।৩৫
প্রহ্লাদ রাখিল নাম নৃসিংহ-মুরারী।।৩৬
বশিষ্ঠ রাখিল নাম মুনি-মনোহর।৩৭
বিশ্বাবসু নাম রাখে নব জলধর।।৩৮
সম্বর্ত্তক নাম রাখে গোবর্দ্ধনধারী।৩৯
প্রাণপতি নাম রাখে যত ব্রজনারী।।৪০
অদিতি রাখিল নাম আরতি-সুদন।৪১
গদাধর নাম রাখে যমল-অর্জুন।।৪২
মহাযোদ্ধা নাম রাখি ভীম মহাবল।৪৩
দয়ানিধি নাম রাখে দরিদ্র সকল।।৪৪
বৃন্দাবন-চন্দ্র নাম রাখে বিন্দুদূতি।৪৫
বিরজা রাখিল নাম যমুনার পতি।।৪৬
বাণী পতি নাম রাখে গুরু বৃহস্পতি।৪৭
লক্ষ্মীপতি নাম রাখে সুমন্ত্র সারথি।।৪৮
সন্দীপনি নাম রাখে দেব অন্তর্যামী।৪৯
পরাশর নাম রাখে ত্রিলোকের স্বাম।।৫০
পদ্মযোনী নাম রাখে অনাদির আদি।৫১
নট-নারায়ন নাম রাখিল সম্বাদি।।৫২
হরেকৃষ্ণ নাম রাখে প্রিয় বলরাম।৫৩
ললিতা রাখিল নাম বাদল-শ্যাম।।৫৪
বিশাখা রাখিল নাম অনঙ্গমোহন।৫৫
সুচিত্রা রাখিল নাম শ্রীবংশীবদন।।৫৬
আয়ন রাখিল নাম ক্রোধ-নিবারণ।৫৭
চন্ডকেশী নাম রাখে কৃতান্ত-শাসন।।৫৮
জ্যোতিষ্ক রাখিল নাম নীলকান্তমণি।৫৯
গোপীকান্ত নাম রাখে সুদাম ঘরণী।।৬০
ভক্তগণ নাম রাখে দেব জগন্নাথ।৬১
দুর্বাসা নাম রাখে অনাথের নাথ।।৬২
রাসেশ্বর নাম রাখে যতেক মালিনী।৬৩
সর্বযজ্ঞেশ্বর নাম রাখেন শিবানী।।৬৪
উদ্ধব রাখিল নাম মিত্র-হিতকারী।৬৫
অক্রুর রাখিল নাম ভব-ভয়হারী।।৬৬
গুঞ্জমালী নাম রাখে নীল-পীতবাস।৬৭
সর্ববেত্তা নাম রাখে দ্বৈপায়ণ ব্যাস।।৬৮
অষ্টসখী নাম রাখে ব্রজের ঈশ্বর।৬৯
সুরলোকে নাম রাখে অখিলের সার।।৭০
বৃষভানু নাম রাখে পরম ঈশ্বর।৭১
স্বর্গবাসী নাম রাখে সর্ব পরাৎপর।।৭২
পুলোমা রাখেন নাম অনাথের সখা।৭৩
রসসিন্ধু নাম রাখে সখী চিত্রলেখা।।৭৪
চিত্ররথ নাম রাখে অরাতি দমন।৭৫
পুলস্ত্য রাখিল নাম নয়ন-রঞ্জন।।৭৬
কশ্যপ রাখেন নাম রাস-রাসেশ্বর।৭৭
ভাণ্ডারীক নাম রাখে পূর্ণ শশধর।।৭৮
সুমালী রাখিল নাম পুরুষ প্রধান।৭৯
পুরঞ্জন নাম রাখে ভক্তগণ প্রাণ।।৮০
রজকিনী নাম রাখে নন্দের দুলাল।৮১
আহ্লাদিনী নাম রাখে ব্রজের গোপাল।।৮২
দেবকী রাখিল নাম নয়নের মণি।৮৩
জ্যোতির্ম্ময় নাম রাখে যাজ্ঞবল্ক্য মুনি।।৮৪
অত্রিমুনি নাম রাখে কোটি চন্দ্রেশ্বর।৮৫
গৌতম রাখিল নাম দেব বিশ্বম্ভর।।৮৬
মরীচি রাখিল নাম অচিন্ত্য-অচ্যুত।৮৭
জ্ঞানাতীত নাম রাখে শৌনকাদিসুখ।।৮৮
রুদ্রগণ নাম রাখে দেব মহাকাল।৮৯
সুরগণ নাম রাখে ঠাকুর দয়াল।।৯০
সিদ্ধগণ নাম রাখে পুতনা-নাশন।৯১
সিদ্ধার্থ রাখিল নাম কপিল তপোধন।।৯২
ভাদুরি রাখিল নাম অগতির গতি।৯৩
মৎস্যগন্ধা নাম রাখে ত্রিলোকের পতি।।৯৪
শুক্রাচার্য্য নাম রাখে অখিল বান্ধব।৯৫
বিষ্ণুলোকে নাম রাখে দেব শ্রীমাধব।।৯৬
যদুগণ নাম রাখে যদুকুলপতি।৯৭
অশ্বিনীকুমার নাম রাখে সৃষ্টি-স্থিতি।।৯৮
অর্য্যমা রাখিল নাম কাল-নিবারণ।৯৯
সত্যবতী নাম রাখে অজ্ঞান-নাশন।।১০০
পদ্মাক্ষ রাখিল নাম ভ্রমরী-ভ্রমর।১০১
ত্রিভঙ্গ রাখিল নাম যত সহচর।।১০২
বংকচন্দ্র নাম রাখে শ্রীরূপমঞ্জরী।১০৩
মাধুরা রাখিল নাম গোপী-মনোহারী।।১০৪
মঞ্জুমালী নাম রাখে অভীষ্টপুরণ।১০৫
কুটিলা রাখিল নাম মদনমোহন।।১০৬
মঞ্জরী রাখিল নাম কর্ম্মব্রহ্ম-নাশ।১০৭
ব্রজব নাম রাখে পূর্ণ অভিলাস।।১০৮
দৈত্যারি দ্বারিকানাথ দারিদ্র-ভঞ্জন।
দয়াময় দ্রৌপদীর লজ্জা-নিবারণ।।
স্বরূপে সবার হয় গোলকেতে স্থিতি।
বৈকুন্ঠে ক্ষীরোদশারী কমলার পতি।।
রসময় রসিক নাগর অনুপম।
নিকুঞ্জবিহারী হরি নবঘনশ্যাম।।
শালগ্রাম দামোদর শ্রীপতি শ্রীধর।
তারকব্রহ্ম সনাতন পরম ঈশ্বর।।
কল্পতরু কমললোচন হৃষীকেশ।
পতিত-পাবন গুরু জ্ঞান-উপদেশ।।
চিন্তামণি চতুর্ভুজ দেব চক্রপাণি।
দীনবন্ধু দেবকী নন্দন যাদুমনি।।
অনন্ত কৃষ্ণের নাম অনন্ত মহিমা।
নারদাদি ব্যাসদেব দিতে নারে সীমা।।
নাম ভজ নাম চিন্ত নাম কর সার।
অনন্ত কৃষ্ণের নাম মহিমা অপার।।
শততার সুবর্ণ গো কোটি কন্যাদান।
তথাপি না হয় কৃষ্ণ নামের সমান।।
যেই নাম সেই কৃষ্ণ ভজ নিষ্ঠা করি।
নামের সহিত আছে আপনি শ্রীহরি।।
শুন শুন ওরে ভাই নাম সংকীর্তন।
যে নাম শ্রবণে হয় পাপ বিমোচন।।
কৃষ্ণনাম হরিনাম বড়ই মধুর।
যেই জন কৃষ্ণ ভজে সে বড় চতুর।।
ব্রহ্ম-আদি দেব যারেঁ ধ্যানে নাহি পায়।
সে ধন বঞ্চিত হলে কি হবে উপায়।।
হিরণ্যকশিপুর উদর-বিদরণ।
প্রহ্লাদে করিল রক্ষা দেব নারায়ণ।।
বলীরে ছলীতে প্রভু হইলা বামন।
দ্রৌপদীর লজ্জা হরি কৈলা নিবারণ।।
অষ্টোত্তর শতনাম যে করে পঠন।
অনায়াসে পায় রাধা কৃষ্ণের চরণ।।
ভক্তবাঞ্ছা পূর্ণকারী নন্দের নন্দন।
মথুরায় কংস-ধ্বংস লঙ্কায় রাবণ।।
বকাসুর বধ আদি কালীয়-দমন।
সরোত্তম কহে এই নাম সংকীর্ত্তণ।
-                                                                         -----সমাপ্ত---                                                                     -হিন্দু ধর্ম দর্শন - দ্বৈতবাদ হিন্দু ধর্মের মত ও পথ নিয়ে সিরিজ এ সবার সহযোগিতা পেয়ে অনেক ভালো লেগেছে। এবার নতুন একটা সিরিজ শুরু করছি হিন্দু দর্শন নিয়ে। আমরা জানি হিন্দু ধর্মে অনেক দর্শনের সমন্বয় ঘটেছে, কেউ বৈষ্ণব, কেউ শৈব, কেউ শাক্ত। তবে আমরা মূল নিয়ে আলোচনা করবো । এই সিরিজে আসবে দ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ ও মায়াবাদ। এগুলো সনাতন ধর্মের একদম মূল কিছু দর্শন। তবে আমি বিশ্বাস করি দর্শন শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ধর্মের না। সকল ধর্মই এখানে আসতে পারে। অন্য ধর্মের সান্নিধ্যতা বা মিল এখানে আসবে। আজকে সবচেয়ে সহজ ও সহজবোধ্য দর্শন নিয়ে আলোচনা করবো তা হচ্ছে দ্বৈতবাদ।

এটাকে সহজ এজন্যই বললাম যে আমাদের স্বাভাবিক জীবনব্যাবস্থা ও ঈশ্বরদর্শনের সাথে এর অনেক মিল। দ্বৈতবাদ সহজ কথায় অর্থ করলে এটা দাড়াচ্ছে দুইটি সত্তা। হ্যা এখানে দুইটি পক্ষ থাকবে। একপক্ষ দানকারী আর অপরপক্ষ হচ্ছে ভক্ত। যেমন ঈশ্বর হচ্ছে আলাদা একটা সত্তা। আর আমরা ভক্তরা আলাদা সত্তা। আমরা সব সময় ঈশ্বরের কাছে তার করুনা , দয়া চাই। সে হচ্ছে বিন্দু আমরা বৃত্তের চারপাশে তাকে কেন্দ্র করে ছুটে চলছি। মূল কথাই হচ্ছে এখানে ঈশ্বর ও ভক্ত সম্পূর্ণ আলাদা একটা সত্তা। পৃথিবী তথা ব্রক্ষ্মান্ড মানুষ থেকে আলাদা। প্রকৃতি ও পুরুষ একে আপর থেকে আলাদা। একটা পক্ষ অপর পক্ষের সান্নিধ্য পাবার জন্য আকুল থাকে। এবং ভক্ত যখন ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাবে তখনই এর পূর্নতা পাবে। দর্শনটা অনেক চেনা ও সহজ লাগছে তাইনা। হ্যা এটা স্বাভাবিকভাবে প্রায় সব ধর্মেই চলে যেমন ইসলাম,খ্রিষ্টান প্রভৃতি। ইসলাম ধর্মে যেমন আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে নামায রোজা করা হয়, তেমনি হিন্দু ধর্মেও আমরা পূজা, অর্চনা, প্রার্থনা যা করি তার প্রায় সবই এই দর্শন অনুসারে। মূলত এটা সাধারণ একটা দর্শন। যার সাথে আমরা পরিচিত। তবে হিন্দু ধর্মে এর পরবর্তী কিছু দর্শন আছে কিন্তু এটা ধারণ না করতে পারলে অন্যগুলো হবেনা তাই এ সম্পর্কে আরো কিছু শ্লোক উদ্ধৃতি করছি।


ঋতং পিবন্তৌ সুকৃতস্য লোকে

গুহাম্প্রবিষ্টৌ পরমে পরার্ধে।   -- কঠোপনিষৎ ৩।১

-- শরীরের পরম উৎকৃষ্ট স্থানে গুহামধ্যে দুইজন প্রবিষ্ট হইয়া আছেন, তন্মধ্যে একজন অবশ্যম্ভাবী কর্মফল ভোগ করেন, অপর একজন তাহা প্রদান করেন।
জীবসংজ্ঞোহন্তরাত্মান্যঃ সহজ সর্বদেহিনাম্‌।
যেন বেদয়তে সর্বং সুখং দুঃখঞ্চ জন্মসু।। --মনুসংহিতা, ১২।১৩

--অন্তরাত্মা নামে একটি স্বতন্ত্র আত্মা প্রত্যেক ব্যাক্তির দেহের সঙ্গে জন্মে, তাহাই সুখ-দুঃখ অনুভব করিয়া থাকে।
দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরাশ্চাক্ষর এব চ।
ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কুটস্থোহক্ষর উচ্যতে।।
উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্য পরমাত্মেতু্যদাহৃতঃ।
যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ।। -- গীতা, ১৫।১৬,১৭

--লোকে দুই প্রকার পুরুষ প্রসিদ্ধ আছে, এক ক্ষর অন্য অক্ষর। সকল পদার্থ ক্ষর আর কুটস্থ (জীবাত্মা) পুরুষ অক্ষর বলিয়া উক্ত হন। কিন্তু অন্য (ক্ষর ও অক্ষর হইতে অতিরিক্ত) এক পুরুষ আছেন, তিনিই উত্তম পুরুষ, তিনিই পরমাত্মা শব্দের বাচ্য। তিনিই ঈশ্বর এবং তিনিই ত্রিলোকের মধ্যে প্রবিষ্ট থাকিয়া এই ত্রিলোককে পালন করেন।
আশা করি উপরের আলোচনাতে দ্বৈতবাদ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পেরেছি আমরা। হিন্দু ধর্মে অনেক মত আছে এটা সত্য তবে সেই মতের পালনকারীকে ও বিভেদ করে দেওয়া হয়েছে। জগতে উত্তম, মধ্যম ও অধম ভেদে তিন প্রকার অধিকারী আছে। যাহারা অধম ও মধ্যম অধিকারী তাদের জন্য এই পথই সর্বোত্তম পথ। তাদের জন্যই ই উপাসনার বিধান করা হয়েছে। উপাস্য ও উপাসক না হলে উপাসনা হইতে পারেনা। সুতরাং ধর্মের প্রথম স্তরের সাধকগণের ভক্তি আকর্ষণ ও কর্মযোগে প্রবৃত্ত করাইবার জন্যই শাস্ত্রে দ্বৈতবাদমূলক উপদেশ করা হয়েছে।
আগামী পর্বে বাকী গুলো ধীরে ধীরে আলোচনা করবো আশা করি। ধন্যবাদ।
                  ঝিনাইদহে গণধর্ষণের শিকার নামযজ্ঞশিল্পী, ৩ ধর্ষক গ্রেপ্তার ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু উপজেলার মান্দারতলা গ্রামে বুধবার গভীর রাতে গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নামযজ্ঞশিল্পী।

এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ৩ ধর্ষককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

গ্রেপ্তারকৃতরা হচ্ছে হরিনাকুন্ডু উপজেলার জোড়াপুকুরিয়া গ্রামের পেশকার আলী ম-লের ছেলে মোস্তফা, একই গ্রামের রুস্তম আলী ম-লের ছেলে লিটন ও মানিকের ছেলে রাজন।

হরিনাকুন্ডু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল খায়ের বাংলানিউজকে জানান, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার বাসিন্দা ওই শিল্পী হরিনাকুন্ডু শহরের চিথলীয়াপাড়ায় নামযজ্ঞ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য বুধবার রাতে ঝিনাইদহ শহরে নামেন।

রাতে তিনি যাত্রী পরিবহন আলমসাধুযোগে হরিনাকুন্ডুর উদ্দেশে রাওনা হন। আলমসাধুটি মান্দারতলা এলাকায় পৌঁছুলে ৬/৭ জন বখাটে চালককে ভয়ভীতি দেখিয়ে ওই শিল্পীকে জোরপূর্বক নামিয়ে নেয়। এরপর তাকে মান্দারতলা গ্রামের আক্কাস আলীর পরিত্যক্ত বাড়িতে নিয়ে গিয়ে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে।

বিষয়টি জানাজানি হলে গ্রামবাসী ধর্ষিতাকে উদ্ধার করে রাতেই তাকে হরিনাকু-ু থানায় পৌঁছে দেয়।

ধর্ষিতা নিজে বাদী হয়ে রাতেই হরিনাকুন্ডু থানায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন।

বৃহস্পতিবার পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৩ ধর্ষককে গ্রেপ্তার করে।

ওসি জানান, ধর্ষণ ঘটনায় আরও ৩/৪ জন জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

তাদেরও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানান ওসি আবুল খায়ের।                                                                                 
দেবদেবীর পরিচয় (৪)    শিবের পরিচয়

ঈশ্বর যে দেবতা রূপে ধ্বংস করেন, তার নাম শিব। প্রকৃত পক্ষে শিব মঙ্গলের দেবতা। মঙ্গলের জন্যই তিনি ধ্বংস করেন।

বেদে সরাসরি শিবের উল্লেখ না থাকলেও শিবের অনুরূপ একজন দেবতার উল্লেখ আছে, তার নাম রুদ্র। রুদ্র শত্রুপক্ষের বীরদের বিনাশ করেন, তিনি রোগ-ব্যাধি দূর করেন। তাকে শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক বলা হয়েছে। পুরাণে শিবকে মহাদেব বলা হয়েছে। শিব ত্রিমূর্তির অন্যতম। লৌকিক দেবতারূপে শিবের পূজা প্রচলিত আছে।






শিবের রূপ

শিবের গায়ের রং তুষারের মত সাদা। তার মাথায় জটা আছে। শিবের তিনটি চোখ। একটি চোখ ঠিক কপালের মাঝখানে। তার মাথার একপাশে একটা বাঁকা চাঁদ রয়েছে। শিবের হাতে থাকে ডমরু ও শিঙ্গা নামক বাদ্যযন্ত্র এবং ত্রিশূল নামক অস্ত্র। তার গলায় থাকে রুদ্রাক্ষের মালা। এ ছাড়াও সর্প তার ভূষণ বা অলংকার। শিবের বাহন বৃষ।
শিবের অনেক নাম। যেমন- মহাদেব, ত্রিপুরারি, ভোলানথ, বৈদ্যনাথ, নীলকন্ঠ ও আশুতোষ ( অর্থাৎ যিনি অল্পে তুষ্ট হন, ইত্যাদী।


শিব পূজার সময়

শিব পঞ্চ দেবতার অন্যতম। সকল দেবতার পূজার সময় শিবের পূজা করা হয়। তবে বিশেষ ভাবে ফল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে ঘটা করে শিবের পূজা করা হয়। এ তিথিতে শিবচতুর্দশী তিথি বলা হয়।

শিবের মাহাত্ম্য

শিব সৃষ্টিকে সংহার করেন। সংহারের পর আবার নতুন সৃষ্টি হয়। শিব মঙ্গল করেন। শিব শব্দটির মানেই মঙ্গল। তিনি অনেক মহৎ কাজ করেছেন। তিনি নাট্য ও নৃত্যে পারদর্শী এবং শিক্ষক। এ জন্য তাকে নটরাজ বলা হয়ভ তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রেও দক্ষ। তাই তাকে বৈদ্যনাথও বলা হয়। তিনি গজাসুরকে বধ করে তার চর্মকে পরিধেয় করেছেন। দেবতা ও দৈত্যরা একত্র হয়ে যখন সমুদ্র মন্থন করেছিলেন, তখন প্রথমে বিষ ওঠে। এই বিষ তিনি চুমুক দিয়ে পান করে কন্ঠে বা গলায় রেখে দেন এ জন্য তার কন্ঠ নীল হয়ে যায়। তাই তার এক নাম নীলকন্ঠ। তিনি দক্ষের যজ্ঞ ধ্বংস করে দিয়ে ছিলেন। মহাভারতের কিরাত নামক আদিবাসীর বেশে তিনি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে অর্জুনের বীরত্ব পরীক্ষা করেছিলেন এবং অর্জুনকে অস্ত্র দিয়েছিলেন। শিবপুরাণসহ অনেক পুরাণে মাহাত্ম্যের বর্ণনা আছে।

পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে ভক্তেরা পূজা করেন। শিবের উপাসকদের শৈব্য বলা হয়।                                                                                                           
মা কালীর কিছু সুন্দর ওয়ালপেপার ( কালেকশনে রাখার মত)                 সামনে মায়ের পুজো- এই কালী পূজাতে আপনাদের সবার জন্য নিয়ে এলাম কিছু সুন্দর মায়ের মূর্তি সম্বলিত ওয়ালপেপার। আসেন দেখেনেই কিছু খুব সুন্দর মায়ের ছবি-
  

 


                                      






















Metal Kali Figurine, 3 Inches



ধন্যবাদ সবাইকে
জয় মা
পৃথিবীর সব চেয়ে উচু মন্দির- ইসকন মায়াপুর /////////////৪

মন্দিরের মাঝে লুকায়িত জ্যামিতিঃ

বাইরের জ্যামিতিঃ
হিন্দু স্থাপত্যে মন্দির ডিজাইন করার জন্য এক লুকানো জ্যামিতিক নিয়মে মন্দিরের ডিজাইন করা হয়। একে বাইরে থেকে অনেকেই বুঝতে পারেন না। কিন্তু মন্দিরের ডিজাইন করার সময় এই জ্যামিতির কারুকাজ বোঝা যায়। এবং এই জ্যামিতির ব্যাবহার হয়ে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে যাকে আজকে আমরা বাস্তু বিদ্যা বলি। এই বাস্তু বিদ্যা হল হিন্দু শাস্ত্রের এক অবিস্মরণীয় অবদান।

মন্দিরের পার্শ্ব চিত্রে সেই জ্যামিতিক খেলা
লুকানো জ্যামিতিঃ

হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে জ্যামিতিকে বলা হয় সৃষ্টির ধারকএই জ্যামিতি সকল সৃষ্টির মাঝে লুকায়িত রুপে দেখা যায়। এই ব্রহ্মাণ্ড এর প্রতিটি বস্তুই জ্যামিতি দ্বারা আচ্ছাদিত।
বৈদিক শাস্ত্র সমূহের বিজ্ঞানের নাম হল বাস্তু শাস্ত্র। এটা হল বাড়ি ও মন্দির স্থাপনার পুরাতন জ্ঞান। যাকে পরবর্তীতে বৌদ্ধ রা নিজেদের মত করে সাজিয়ে নেয় এবং নাম দেয় ফেং সুই। এই বাস্তু বিদ্যাতেই নিহিত আছে সমস্থ পৃথিবীর স্থাপত্য জ্ঞান।
এই মন্দির ঈশ্বর স্তব এবং বৈদিক প্লানেটারিয়াম হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। তাই এতে রাখা হয়েছে বাস্তু বিদ্যার সকল সুত্র সমূহ


মন্দিরের প্লান


বাস্তু পুরুষ মণ্ডল এর গ্রিড অনুযায়ী এই মন্দিরের প্লান আঁকা হয়েছে। বাস্তু পুরুষের ব্রহ্ম মন্ডলে মন্দিরের গর্ভ গৃহ অবস্থান করছে। মন্দিরের পুরো জমিটাকে বাস্তু মতে ৩২ ভাগে ভাগকরে এই প্লান করা হয়েছ্যেছ

ফ্লোর প্লান এ বাস্তু পুরুষ মন্ডল

নিকোলাস কোপারনিকাস নয়টি মণ্ডল নির্বাচন করেছিলেন বাস্তু পুরুষ মণ্ডল এর। এই প্ল্যানে নবম মণ্ডল হিসেবে পৃথিবীকে ধরা হয়েছে।

এভাবেই সময়কে বিশ্লেষন করে বাস্তুর মাধ্যমে হিন্দু মন্দির সমূহের ডিজাইন করা হচ্ছে হাজারো বছর ধরে।

মন্দিরের স্কেল / উচ্চতা

এই মন্দিরের উচ্চতা সম্পর্কে শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন যে এটা- ত্রিশ তলা বাড়ির সমান উচু হবে।এবং এটা টিকে থাকবে হাজারো বছর। মন্দিরের এই উচ্চতা আনার জন্য বাস্তু পুরুষের জ্যামিতি ব্যাবহার করা হয়েছে।

আকাশের ও নক্ষত্র রাজির সাথে সম্পর্ক স্থাপন
আকাশের গ্রহ নক্ষত্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে এই মন্দিরের ডিজাইনে এক পরিকল্পিত নকশা বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
সূর্যের সাথে সম্পর্ক

সূর্যের রশ্মির সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এই মন্দিরের ব্যাপ্তি উচ্চতার সাথে এভাবে পরিমাপ করা বানানো হবে। এই ব্যাপ্তি সূর্যের সাথে ২৩.৫ কোনে আবর্তিত। এই ডিজাইন বাস্তবায়ন হলে যে কোন কেউ মন্দিরের যে কোন প্রান্ত থেকে মন্দিরের সকল অংশ দেখতে পাবেন।
গ্রীষ্ম ও বসন্ত কালে

সূর্যের উত্তরায়ণ এবং দক্ষিনায়নের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য এই মন্দিরে রাখা হয়েছে কাঁচের আবরণ যার ফলে যে কোন ঋতু তে সূর্য রশ্মি এই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারবে।


খুবই দুঃখের সাথে জানাচ্ছি এই পর্বে ও এই লেখা সমাপ্ত করা গেলনা। এই বিশাল মন্দিরের এত ফিচার একসাথে লেখা অনেক কষ্টের। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন এই অনিচ্ছা কৃত অপরাধের জন্য।

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত //////////১৩ পঞ্চম পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ৫ই অগস্ট

ভক্তিযোগের রহস্য — The Secret of Dualism

শ্রীরামকৃষ্ণ — বিজ্ঞানী কেন ভক্তি লয়ে থাকে? এর উত্তর এই যে, ‘আমি’ যায় না। সমাধি অবস্থায় যায় বটে, কিন্তু আবার এসে পড়ে। আর সাধারণ জীবের ‘অহং’ যায় না। অশ্বত্থগাছ কেটে দাও, আবার তার পরদিন ফেঁক্‌ড়ি বেরিয়েছে। (সকলের হাস্য)

“জ্ঞানলাভের পরও আবার কোথা থেকে ‘আমি’ এসে পড়ে! স্বপনে বাঘ দেখেছিলে, তারপর জাগলে, তবুও তোমার বুক দুড়দুড় করছে। জীবের আমি লয়েই তো যত যন্ত্রণা। গরু ‘হাম্বা’ (আমি) ‘হাম্বা’ করে, তাই তো অত যন্ত্রণা। লাঙলে জোড়ে, রোদবৃষ্টি গায়ের উপর দিয়ে যায়, আবার কসাইয়ে কাটে, চামড়ায় জুতো হয়, ঢোল হয় — তখন খুব পেটে। (হাস্য)

“তবুও নিস্তার নাই। শেষে নাড়ীভুঁড়ি থেকে তাঁত তৈয়ার হয়। সেই তাঁতে ধুনুরীর যন্ত্র হয়। তখন আর ‘আমি’ বলে না, তখন বলে ‘তুঁহু’ ‘তুঁহু’ (অর্থাৎ ‘তুমি’, ‘তুমি’)। যখন ‘তুমি’, ‘তুমি’ বলে তখন নিস্তার। হে ইশ্বর, আমি দাস, তুমি প্রভু, আমি ছেলে, তুমি মা।

“রাম জিজ্ঞাসা করলেন, হনুমান, তুমি আমায় কিভাবে দেখ? হনুমান বললে, রাম! যখন ‘আমি’ বলে আমার বোধ থাকে, তখন দেখি, তুমি পুর্ণ, আমি অংশ; তুমি প্রভু, আমি দাস। আর রাম! যখন তত্ত্বজ্ঞান হয়, তখন দেখি, তুমিই আমি, আমিই তুমি।

“সেব্য-সেবক ভাবই ভাল। ‘আমি’ তো যাবার নয়। তবে থাক শালা ‘দাস আমি’ হয়ে।”

বিদ্যাসাগরকে শিক্ষা — “আমি ও আমার” অজ্ঞান

“আমি ও আমার এই দুটি অজ্ঞান। ‘আমার বাড়ি’, ‘আমার টাকা’, ‘আমার বিদ্যা’, ‘আমার এই সব ঐশ্বর্য’ — এই যে-ভাব এটি অজ্ঞান থেকে হয়। ‘হে ঈশ্বর, তুমি কর্তা আর এ-সব তোমার জিনিস — বাড়ি, পরিবার, ছেলেপুলে, লোকজন, বন্ধু-বান্ধব — এ-সব তোমার জিনিস’ — এ-ভাব থেকে জ্ঞান হয়।

মৃত্যুকে সর্বদা মনে রাখা উচিত। মরবার পর কিছুই থাকবে না। এখানে কতকগুলি কর্ম করতে আসা। যেমন পাড়াগাঁয়ে বাড়ি — কলকাতায় কর্ম করতে আসা। বড় মানুষের বাগানের সরকার, বাগান যদি কেউ দেখতে আসে, তা বলে ‘এ-বাগানটি আমাদের’, ‘এ-পুকুর আমাদের পুকুর’। কিন্তু কোন দোষ দেখে বাবু যদি ছাড়িয়ে দেয়, আর আমের সিন্দুকটা লয়ে যাবার যোগ্যতা থাকে না; দারোয়ানকে দিয়ে সিন্দুকটা পাঠিয়ে দেয়। (হাস্য)

“ভগবান দুই কথায় হাসেন। কবিরাজ যখন রোগীর মাকে বলে, ‘মা! ভয় কি? আমি তোমার ছেলেকে ভাল করে দিব’ — তখন একবার হাসেন; এই বলে হাসেন, আমি মারছি, আর এ কিনা বলে আমি বাঁচাব! কবিরাজ ভাবছে, আমি কর্তা, ঈশ্বর যে কর্তা — এ-কথা ভুলে গেছে। তারপর যখন দুই ভাই দড়ি ফেলে জায়গা ভাগ করে, আর বলে ‘এদিকটা আমার, ওদিকটা তোমার’, তখন ঈশ্বর আর-একবার হাসেন, এই মনে করে হাসেন; আমার জগদ্‌ব্রহ্মাণ্ড, কিন্তু ওরা বলছে, ‘এ-জায়গা আমার আর তোমার’।”

উপায় — বিশ্বাস ও ভক্তি

“তাঁকে কি বিচার করে জানা যায়? তাঁর দাস হয়ে, তাঁর শরণাগত হয়ে তাঁকে ডাক।

(বিদ্যাসাগরের প্রতি সহাস্যে) — “আচ্ছা, তোমার কি ভাব?”

বিদ্যাসাগর মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। বলিতেছেন, “আচ্ছা সে কথা আপনাকে একলা-একলা একদিন বলব।” (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — তাঁকে পাণ্ডিত্য দ্বারা বিচার করে জানা যায় না।

এই বলিয়া ঠাকুর প্রেমোন্মত্ত হইয়া গান ধরিলেন:

ঈশ্বর অগম্য ও অপার

কে জানে কালী কেমন?
ষড় দর্শনে না পায় দরশন ৷৷
মূলাধারে সহস্রারে সদা যোগী করে মনন ।
কালী পদ্মবনে হংস-সনে, হংসীরূপে করে রমণ ৷৷ আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন ।
তিনি ঘটে ঘটে বিরাজ করেন, ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন ৷৷
মায়ের উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড, প্রকাণ্ড তা জানো কেমন ।
মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম, অন্য কেবা জানে তেমন ৷৷
প্রসাদ ভাষে লোকে হাসে, সন্তরণে সিন্ধু-তরণ ।
আমার মন বুঝেছে প্রাণ বুঝে না ধরবে শশী হয়ে বামন ৷৷

“দেখলে, কালীর ‘উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা জানো কেমন’! আর বলছে, ‘ষড় দর্শনে না পায় দরশন’ — পাণ্ডিত্যে তাঁকে পাওয়া যায় না।”

বিশ্বাসের জোর — ঈশ্বরে বিশ্বাস ও মহাপাতক

“বিশ্বাস আর ভক্তি চাই — বিশ্বাসের কত জোর শুনঃ একজন লঙ্কা থেকে সমুদ্র পার হবে, বিভীষণ বললে, এই জিনিসটি কাপড়ের খুঁটে বেঁধে লও। তাহলে নির্বিঘ্নে চলে যাবে; জলের উপর দিয়ে চলে যেতে পারবে। কিন্তু খুলে দেখো না; খুলে দেখতে গেলেই ডুবে যাবে। সে লোকটা সমুদ্রের উপর দিয়ে বেশ চলে যাচ্ছিল। বিশ্বাসের এমন জোর। খানিক পথ গিয়ে ভাবছে, বিভীষণ এমন কি জিজিস বেঁধে দিলেন যে, জলের উপর দিয়ে চলে যেতে পাচ্ছি? এই বলে কাপড়ের খুঁটটি খুলে দেখে, যে শুধু ‘রাম’ নাম লেখা একটি পাতা রয়েছে। তখন সে ভাবলে, এঃ, এই জিনিস! ভাবাও যা, অমনি ডুবে যাওয়া।

“কথায় বলে হনুমানের রামনামে এত বিশ্বাস যে, বিশ্বাসের গুণে ‘সাগর লঙ্ঘন’ করলে! কিন্তু স্বয়ং রামের সাগর বাঁধতে হল!

“যদি তাঁতে বিশ্বাস থাকে, তাহলে পাপই করুক, আর মহাপাতকই করুক, কিছুতেই ভয় নাই।”

এই বলিয়া ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তের ভাব আরোপ করিয়া ভাবে মাতোয়ারা হইয়া বিশ্বাসের মাহাত্ম্য গাহিতেছেন:

আমি দুর্গা দুর্গা বলে মা যদি মরি।
আখেরে এ-দীনে, না তারো কেমনে, জানা যাবে গো শঙ্করী।                       
কিংবদন্তি খনা - বাস্তব নাকি সত্য? ///////২ প্রথম পর্বের পর 
বোবার বিজ্ঞান
প্রচলিত গল্পে খনা ছিলেন লঙ্কাদ্বীপের রাজকুমারীমতান্তরে রাক্ষসকবলিত কোনো এক রাজ্যের অনিন্দ্যসুন্দর রাজকুমারীর নাম ছিল লীলাবতী যিনি পরে খনা নামে পরিচিত হনখনা অর্থ বোবা এবং জিহ্বা কর্তনের পর নামটি প্রতিষ্ঠা পায়কথিত আছে, জ্যোতিষশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞানের ফলে খনা প্রায়ই রাজসভাতে আমন্ত্রিত হতেনফলে প্রতিহিংসাপরায়ণ শ্বশুর বরাহ মিহির ছেলে মিহিরকে লীলাবতীর জিহ্বা কাটার নির্দেশ দেনবাবার নির্দেশে মিহির খনার জিহ্বা কর্তন করেনতবে গল্পমতে কথিত রাজকন্যা স্বামীর কাছে অনুরোধ করেন যে, জিহ্বা কর্তনের আগে কিছু বলতে চানস্বামী অনুমতি দেনএ সময় খনা আবাদ, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, যাত্রা, গবাদি, শস্যাদি, ফলাদি, গ্রহ-নক্ষত্রাদি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত বচন দেন যা পরে খনার বচন নামে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়খনার বচন সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কৃষক সামজে; যাদের কোনো লিখিত ভাষা নেইমুখে মুখে প্রচলিত এসব ভাষা যুগ যুগ ধরে তাদের কৃষিকাজ এবং জীবনাচারে প্রভাবিত হয়েছেআধুনিক বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে সোজা চোখে না দেখলেও খনার বচন তার অবশ্যম্ভাব্যতা থেকে কক্ষচ্যুত হয়নিবরং গ্রামের কৃষকরা বিজ্ঞানের ভাষার চেয়ে প্রবাদ-প্রবচনে অধিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেতবে অনেক বিজ্ঞজন খনার বচনকে আধুনিক বিজ্ঞান হিসেবে অভিহিত করতে গিয়ে প্রবচনগুলো খনার বিজ্ঞান হিসেবে অভিজ্ঞান করেনবচনগুলো অষ্টম অথবা নবম শতাব্দীতে রচিততবে আজো তা নির্ভুল ও সূক্ষ্মদৃষ্টিসম্পন্ন নীতিবাক্য হিসেবেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত
খনাকে বিশ্লেষণের আরো পথ আছে-
রণদীপম বসু বলেছেন
আমাদের সাহিত্যের লৌকিক বাংলায় ছন্দের প্রথম দোলাটা প্রথম কাকে কখন কোথায় কীভাবে দিয়েছিলো তা জানার সুযোগ না হলেও খনানামের আড়ালে মূলত লোকায়ত জনভাষ্যগুলোই যে মৃত্তিকালগ্ন জীবনলগ্ন হয়ে বহুকাল যাব আমাদের জনরুচিকে চটুল নৃত্যে দুলিয়ে এসেছে তা সহজেই অনুমেয়উঠতে বসতে বিবাহে যাপনে ফসলে বুননে হাসিতে আড্ডায় দুঃখে কষ্টে এক কথায় বাঙালি জীবনের প্রতিটি স্পন্দনে শিক্ষণীয়, নিন্দনীয়, বিদ্রুপ কটাক্ষ বা নির্দোষ মজা করার যে শ্লোকগুলো এখনো ভেসে বেড়ায় গ্রামবাংলার লৌকিক জনপদে মুখে মুখে, এগুলোর রচয়িতার নাম কেউ না জানলেও এতে ছন্দের চমকারিত্ব, বুদ্ধির ঝিলিক আর জীবনঘনিষ্ট শব্দের আশ্চর্য শক্তিমত্তায় সন্দেহের কোন অবকাশ নেইকলা রুয়ে না কেটো পাত/ তাতেই কাপড় তাতেই ভাতঅথবা ষোল চাষে মুলা/ তার অর্ধেক তুলা/ তার অর্ধেক ধান/ বিনা চাষে পান’ (খনার বচন)আমাদেরই পূর্বপুরুষদের এই সৃষ্টিশীল উজ্জ্বলতাগুলো নিজস্ব ক্ষমতাশৈলীর জোরেই স্বমহিমায় টিকে আছে এখনোশাসন করছে লোকায়ত মনোভূমিকেএগুলোই বচন, শোলক বা ছড়া নামে সমধিক পরিচিত হয়ে আসছে
খুবই লক্ষণীয় যে, প্রায় সব ছড়াতেই আমাদের লৌকিক কবিরা স্বরবৃত্তের হালকা চটুল ছন্দ ব্যবহার করেছেনস্বরের স্বতঃস্ফূর্ত গতিদোলার সাথে স্বাভাবিক শ্বাসাঘাতের অনুরণনের মাধমে ছন্দশীল কথাগুলো প্রাকৃতিকভাবেই এগিয়ে যায় বলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ছন্দকে প্রাকৃতিক বা লৌকিক ছন্দ হিসেবে চিহ্নিত করেছেনহালকা চালের এই ছড়াগুলোতে সমকালীন লোকজীবনের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকেও লোকায়ত জীবনধারার সাথে মিশিয়ে আশ্চর্য নিপুনতায় প্রকাশ করা হয়েছেছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে?/ ধান ফুরুল, পান ফুরুল খাজনার উপায় কি?/ আর কটা দিন সবুর কর, রসুন বুনেছি
কিশোরকবিতার কোষ্ঠীবিচার করতে হলে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত লৌকিক কবিদের এই লোকায়ত ধারাটিকে কিছুতেই ভুলে যাওয়া চলবে না আমাদের

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত //////////১২ চতুর্থ পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ৫ই অগস্ট

জ্ঞান ও বিজ্ঞান, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও দ্বৈতবাদ — এই তিনের সমন্বয় — Reconciliation of Non-Dualism, Qualified Non-Dualism and Dualism.

শ্রীরামকৃষ্ণ — ঋষিদের ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছিল। বিষয়বুদ্ধির লেশমাত্র থাকলে এই ব্রহ্মজ্ঞান হয় না। ঋষিরা কত খাটত। সকাল বেলা আশ্রম থেকে চলে যেত। একলা সমস্ত দিন ধ্যান চিন্তা করত, রাত্রে আশ্রমে ফিরে এসে কিছু ফলমূল খেত। দেখা, শুনা, ছোঁয়া — এ-সবের বিষয় থেকে মনকে আলাদা রাখত, তবে ব্রহ্মকে বোধে বোধ করত।

“কলিতে অন্নগত প্রাণ, দেহবুদ্ধি যায় না। এ-অবস্থায় ‘সোঽহং’ বলা ভাল নয়। সবই করা যাচ্ছে, আবার ‘আমিই ব্রহ্ম’ বলা ঠিক নয়। যারা বিষয় ত্যাগ করতে পারে না, যাদের ‘আমি’ কোন মতে যাচ্ছে না, তাদের ‘আমি দাস’ ‘আমি ভক্ত’ এ-অভিমান ভাল। ভক্তিপথে থাকলেও তাঁকে পাওয়া যায়।

“জ্ঞানী ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে বিষয়বুদ্ধি ত্যাগ করে, তবে ব্রহ্মকে জানতে পারে। যেমন সিঁড়ির ধাপ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে ছাদে পৌঁছানো যায়। কিন্তু বিজ্ঞানী যিনি বিশেষরূপে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেন তিনি আরও কিছু দর্শন করেন। তিনি দেখেন, ছাদ যে জিনিসে তৈয়ারি — সেই ইঁট, চুন, সুরকিতেই, সিঁড়িও তৈয়ারি। ‘নেতি’ ‘নেতি’ করে যাঁকে ব্রহ্ম বলে বোধ হয়েছে তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন। বিজ্ঞানী দেখে, যিনি নির্গুণ, তিনিই সগুণ।

“ছাদে অনেকক্ষণ লোক থাকতে পারে না, আবার নেমে আসে। যাঁরা সমাধিস্থ হয়ে ব্রহ্মদর্শন করেছেন, তাঁরাও নেমে এসে দেখেন যে, জীবজগৎ তিনিই হয়েছেন। সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি। নি-তে অনেকক্ষণ থাকা যায় না। ‘আমি’ যায় না; তখন দেখে, তিনিই আমি, তিনিই জীবজগৎ সব। এরই নাম বিজ্ঞান।

“জ্ঞানীর পথও পথ। জ্ঞান-ভক্তির পথও পথ। আবার ভক্তির পথও পথ। জ্ঞানযোগও সত্য, ভক্তিপথও সত্য — সব পথ দিয়ে তাঁর কাছে যাওয়া যায়। তিনি যতক্ষণ ‘আমি’ রেখে দেন, ততক্ষণ ভক্তিপথই সোজা।

“বিজ্ঞানী দেখে ব্রহ্ম অটল, নিষ্ক্রিয়, সুমেরুবৎ। এই জগৎসংসার তাঁর সত্ত্ব রজঃ তমঃ তিন গুণে রয়েছে। তিনি নির্লিপ্ত।

“বিজ্ঞানী দেখে যিনিই ব্রহ্ম তিনিই ভগবান, যিনিই গুণাতীত, তিনিই ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ ভগবান। এই জীবজগৎ, মন-বুদ্ধি, ভক্তি-বৈরাগ্য-জ্ঞান — এ-সব তাঁর ঐশ্বর্য। (সহাস্য) যে বাবুর ঘর-দ্বার নাই, হয়তো বিকিয়ে গেল সে বাবু কিসের বাবু। (সকলের হাস্য) ঈশ্বর ষড়ৈশ্বর্যপূর্ণ। সে ব্যক্তির যদি ঐশ্বর্য না থাকত তাহলে কে মানত!” (সকলের হাস্য)

বিভুরূপে এক — কিন্তু শক্তিবিশেষ

“দেখ না, এই জগৎ কি চমৎকার। কতরকম জিনিস — চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র। কতরকম জীব। বড়, ছোট, ভাল, মন্দ, কারু বেশি শক্তি, কারু কম শক্তি।”

বিদ্যাসাগর — তিনি কি কারুকে বেশি শক্তি, কারুকে কম শক্তি দিয়েছেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তিনি বিভুরূপে সর্বভূতে আছেন। পিঁপড়েতে পর্যন্ত। কিন্তু শক্তিবিশেষ। তা না হলে একজন লোকে দশজনকে হারিয়ে দেয়, আবার কেউ একজনের কাছ থেকে পালায়, আর তা না হলে তোমাকেই বা সবাই মানে কেন? তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো? (হাস্য) তোমার দয়া, তোমার বিদ্যা আছে — অন্যের চেয়ে, তাই তোমাকে লোকে মানে, দেখতে আসে। তুমি এ-কথা মানো কি না? বিদ্যাসাগর মৃদু মৃদু হাসিতেছেন।

শুধু পান্ডিত্য, পুঁথিগত বিদ্যা অসার — ভক্তিই সার

শ্রীরামকৃষ্ণ — শুধু পাণ্ডিত্যে কিছু নাই। তাঁকে পাবার উপায়, তাঁকে জানবার জন্যই বই পড়া। একটি সাধুর পুঁথিতে কি আছে, একজন জিজ্ঞাসা করলে, সাধু খুলে দেখালে। পাতায় পাতায় “ওঁ রামঃ” লেখা রয়েছে, আর কিছুই লেখা নাই!

“গীতার অর্থ কি? দশবার বললে যা হয়। ‘গীতা’ ‘গীতা’, দশবার বলতে গেলে, ‘ত্যাগী’ ‘ত্যাগী’ হয়ে যায়। গীতায় এই শিক্ষা — হে জীব, সব ত্যাগ করে ভগবানকে লাভ করবার চেষ্টা কর। সাধুই হোক, সংসারীই হোক, মন থেকে সব আসক্তি ত্যাগ করতে হয়।

“চৈতন্যদেব যখন দক্ষিণে তীর্থভ্রমণ করছিলেন — দেখলেন, একজন গীতা পড়ছে। আর-একজন একটু দূরে বসে শুনছে, আর কাঁদছে — কেঁদে চোখ ভেসে যাচ্ছে। চৈতন্যদেব জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এ-সব বুঝতে পারছ? সে বললে, ঠাকুর! আমি শ্লোক এ-সব কিছু বুঝতে পারছিনা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তবে কেন কাঁদছো? ভক্তটি বললে, আমি দেখছি অর্জুনের রথ, আর তার সামনে ঠাকুর আর অর্জুন কথা কচ্চেন। তাই দেখে আমি কাঁদছি।
কিংবদন্তি খনা - বাস্তব নাকি সত্য? ///////১
খনা এই নামটি নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তিখনা ছিলেন সিংহল রাজার কন্যাএক শুভক্ষণে তার জন্ম বলে নাম দেওয়া হয় ক্ষণাআর ক্ষণা থেকেই খনা নামের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়খ্রিস্টীয় ৫০০ অব্দে প্রাচীন ভারতবর্ষের অবন্তী রাজ্যের রাজা ছিলেন বিক্রমাদিত্যতার রাজপ্রাসাদের প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ ছিলেন বরাহমিহিরবরাহের ঘরে পুত্রসন্তান জন্ম নিলে নাম রাখেন মিহিরশিশুটির কষ্ঠি বিচার করে তিনি দেখলেন, শিশুটির পরমায়ু মাত্র এক বছরতাই বরাহ একটি পাত্রে মিহিরকে রেখে সমুদ্রজলে ভাসিয়ে দেনপাত্রটি ভাসতে ভাসতে এসে উপস্থিত হয় সিংহল দ্বীপের উপকূলেপরে রাজা তাকে তুলে নিয়ে লালন-পালন করেন এবং খনার সঙ্গে বিয়ে দেনদুজনই জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শিতা লাভ করেমিহির খনাকে নিয়ে নিজ জন্মভূমিতে ফিরে আসেনপিতার মতো মিহিরও বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় প্রতিপত্তি লাভ করেনএকদিন রাজা আকাশে নক্ষত্রের সংখ্যা কত জানতে চাইলে পিতা-পুত্র তা নির্ধারণে অক্ষম হয়ে খনার সাহায্যে কৃতকার্য হনএতে সম্মানহানির ভয়ে মিহির খনার জিহ্বা কেটে ফেলেনএর কিছুদিন পরই খনার মৃত্যু হয়
কিন্তু এই কিংবদন্তি কাহিনী সত্য কি-না তা নিয়ে সন্দেহ আছেকারণ, বিক্রমাদিত্যের শাসনামলে বরাহমিহির একজনই ছিলেনতবে খনার বচনগুলোর অধিকাংশ লিখিত হয়েছে বাংলায়বচনগুলোর ভাষা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলছেন, এগুলোর রচনাকাল ৪০০ বছর আগের নয়কিন্তু বরাহমিহিরের আবির্ভাবকাল প্রায় দেড় হাজার বছর আগে! বরাহমিহিরের জাতক প্রভৃতি জ্যোতিষ গ্রন্থের সঙ্গে খনার বচনের কতগুলো অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়কৃষিসংক্রান্ত নানা বিষয় সম্পর্কে খনার বচনগুলো অমূল্য সম্পদ এবং কৃষিজীবীদের কাছে খুবই আদরণীয়


খনার কিংবদন্তি

১. তাকে নিয়ে প্রচলিত নানা কাহিনী এদের সাধারণ সুতোটি হচ্ছে, উপমহাদেশের প্রাচীন রাজ্য অবন্তী (Avanti) তথা উজ্জয়নের (Ujjain) রাজা হর্ষ-বিক্রমাদিত্যের (Harsha Vikramaditya) রাজপ্রাসাদে প্রধান জ্যোতির্বিদ ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহির (Varahamihira), আনুমানিক ৫০০ খ্রীষ্টাব্দের কথা বরাহমিহিরের পুত্র জন্মগ্রহণ করলে তিনি পুত্রের কোষ্ঠি (horoscope) বিচার করে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান হিসেব করে দেখেন মাত্র এক বছরের মধ্যেই মারা যাবে তার প্রিয় শিশুপুত্র পিতা হয়ে পুত্রের মৃত্যু অসহায়ের মত অবলোকন করতে হবে আর ভয়ংকর দিনগুলি গণনা করে যেতে হবে, এই চিন্তা সহ্য করতে না পরে তিনি ভাসিয়ে দেন পুত্রকে, পাত্রে ভরে নদীর স্রোতে

অনেক দূরের এক রাজ্যে, নদী থেকে শিশুটিকে উদ্ধার করে রাক্ষস সম্প্রদায় কিন্তু মারা যায় না শিশু, বড় হতে থাকে রাক্ষসদের মধ্যে ষোল বছর বয়সে শাণিত বুদ্ধির এক রাক্ষস মেয়ের প্রেমে পড়ে যায় সে, বিয়ে করে তাকে মেয়েটি তার জ্যোতির্জ্ঞান প্রয়োগ করে জানতে পারে তার স্বামী মিহির উজ্জয়নের বিখ্যাত পন্ডিত বরাহমিহিরের পুত্র একদিন দুজন মিলে রওয়ানা দেয় উজ্জয়নের পথে

পুত্র-পুত্রবধুর পরিচয় পেয়ে রাজপ্রাসাদে তাদের গ্রহণ করেন বরাহ কৃষিকাজে মেয়েটির ছিল অগাধ জ্ঞান আর গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান বিচার করে আবহাওয়ার চমকার পূর্বাভাস দিতে পারত সে উজ্জয়নের কৃষকরা ব্যাপক উপকার লাভ করে তার কাছ থেকে, আর তা দেখে রাজা বিক্রমাদিত্য মেয়েটিকে তার রাজ্যের দশম রত্ন (tenth jewel) হিসেবে আখ্য দেন মেয়েটির জ্ঞানে সারা রাজ্য রাজপ্রাসাদ মুগ্ধ হয়ে রইল, পন্ডিত বরাহের খোঁজ আর কেউ নেয় না এমনকি বরাহ নিজেও জনসমক্ষে এক বিতর্কে পুত্রবধুর হাতে পরাস্ত হন ঈর্ষাপরায়ণ বরাহ তাই এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পুত্রকে আদেশ দেন মেয়েটির জিহ্বা কেটে ফেলতে যাতে চিরতরে স্তব্ধ হয়ে যায় তার কন্ঠ আর ঘটেও যায় এই মর্মন্তুদ ঘটনা!

উড়িষ্যার উপাখ্যানটিতে বর্ণিত আছে, রক্তক্ষয়ী এই ঘটনার পর মেয়েটির নাম হয় খনা, উড়িয়া ভাষায় যার মানে বোবা

বাংলার এক কিংবদন্তীতে আছে, জন্মের পর মেয়েটির পিতা তার নাম রাখেন খনা কারণ তার জন্ম হয়েছিল এক শুভক্ষণে কিন্তু বাংলার এই মেয়েটি বেড়ে উঠে লঙ্কা নামের রাক্ষস দ্বীপে (বর্তমানের Sri Lanka) মধ্যযুগীয় কিছু বর্ণনায়, যেমন কালহানের রত্নরঙ্গিনীতে, বাংলার গৌড় (Gauda) কেই অবশ্য রাক্ষস রাজ্য (Kingdom of Demons) হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে


বরাহমিহির প্রাচীন ভারতের (আনুমানিক ৫০৫ - ৫৮৭) একজন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং কবি। তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়াও গণিতশাস্ত্র, পূর্তবিদ্যা, আবহবিদ্যা, এবং স্থাপত্যবিদ্যায় পণ্ডিত ছিলেন।

এই মনীষীর জন্ম ভারতের অবন্তিনগরে। রাজা বিক্রমাদিত্যের সভার নবরত্নের অন্যতম হিসেবে তিনি স্বীকৃত। ভারতীয় পঞ্জিকার অন্যতম সংস্কারক ছিলেন তিনি। তিনিই বছর গণনার সময় বেশাখকে প্রথম মাস হিসেবে ধরার প্রচলন করেন। আগে চৈত্র এবং বৈশাখকে বসন্ত ঋতুর অন্তর্গত ধরা হতো। পৃথিবীর আকার এবং আকৃতি সম্বন্ধে তার সঠিক ধারণা ছিল। তার জন্ম ৫৮৭ ধরা হলেও কারও কারও মতে তা ৫৭৮।
তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে:

•পঞ্চসিদ্ধান্তিকা; ৫৫০ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়। পাঁচটা খন্ড নিয়ে গঠিত এই বইটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। পাঁচটি খন্ড হচ্ছ: সূর্যসিদ্ধান্ত, রোমকসিদ্ধান্ত, পৌলিশসিদ্ধান্ত, পৈতামহসিদ্ধান্ত এবং বাশিষ্ঠসিদ্ধান্ত। আরব দার্শনিক আল খোয়ারিজমি সূর্যসিদ্ধান্ত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আল জিবর ব আল মুকাবলা রচনা করেন বলে মনে করা হয়।
•বৃহৎসংহিতা; একটি প্রসিদ্ধ জ্যোতিষ গ্রন্থ যা পদ্য আকারে লিখা। এতে তিনি জ্যোতিষী দৃষ্টিকোণ থেকে বহু পাথরের বিবরণ এবং পাক-ভারতের ভৌগলিক তথ্য সন্নিবেশিত করেন। এছাড়াও এতে সূর্য ও চন্দ্রের গতি ও প্রভাব, আবহবিদ্যা, স্থাপত্য এবং পূর্তবিদ্যার নানা বিষয় প্রসঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা আলোচিত হয়েছে। এই বইয়েই তিনি ব্রজলেপ নামে একটি বস্তুর প্রস্তুতপ্রণালী ব্যাখ্যা করেছেন যা আধুনিককালের সিমেন্টের সমগোত্রীয় ছিল। সে সময় ভারতে বরাহমিহির উদ্ভাবিত এই ব্রজলেপ দিয়েই বড় বড় দালান কোঠার ইটের গাঁথুনি তৈরীতে ব্যবহৃত হতো।


রহস্যময় এক ভগ্নাবশেষ

কোলকাতা শহরের ৪০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে বারাসাত নগরীর কাছে বীরচম্পা (Berachampa) নামক জায়গায় গেলে দেখা যাবে প্রাচীন এক ভগ্নাবশেষ (ruins), মহাসড়কের উভয়পাশে বিস্তৃত দক্ষিণ পাশে পরিলক্ষ্যিত হয় প্রাচীন দুর্গ (fort) প্রতিরক্ষাবেষ্টনি বা গড় (rampart) এর নিদর্শন ধারণা করা হয়, এখানেই ছিল রাজা চন্দ্রকেতুর (Chandraketu) সাম্রাজ্য কৃষিকাজ বা অন্যান্য খননকাজে মাটির নীচ থেকে প্রায়ই বেরিয়ে আসে নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন (artefacts): মুদ্রা, পুঁতি (bead), প্রস্তর ও পোড়ামাটির ভাস্কর্য (stone & terracotta sculpture), গজদন্ত (ivory), উন্মোচন করে টুকরো টুকরো কত না ইতিহাস নিদর্শনগুলির শুধু মাত্র সংখ্যার প্রাচুর্যই মুগ্ধ করে রাখার মত যথেষ্ঠ

২৪ পরগনা জেলায় অবস্থিত এই এলাকাটিতে ১৯৫০ এর দশকে কিছু খননকার্য হয়েছিল রোমান ও ভূমধ্যসাগরীয় মুদ্রা পর্যবেক্ষণ করে ঐতিহাসিকদের অভিমত, এখানকার স্থাপনাসমূহ খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের পুরাতত্ত্ববিদগন (archeologist) এখানে মৌর্য্য (Maurya) ও গুপ্ত (Gupta) শাসনামলের নিদর্শনও আবিষ্কার করেছেন কিন্তু তৈজসপত্রের টুকরা (pot-sherds) এবং গোলাকার সিলমোহরের (seal) উপর খোদাইকরা অভিলিখন (inscription) এর মর্মোদ্ধার করা এখনও হয়ে উঠেনি, ফলে রাজা চন্দ্রকেতুর সঠিক পরিচয় এবং সেই এলাকার ইতিহাস এখনও আলো-আধাঁরিতে খেলা করে

আর এখানেই, মহাসড়কের উত্তর পাশে শায়িত সমাধিফলকের মত এক ইঁটের স্থাপনা বহুভুজাকৃতির উঁচু এই স্থাপনাটি কৌতূহল জাগানোর মত উত্তর-দক্ষিণে সুবিন্যস্ত, পাশে আরো কিছু স্থাপনা এটিই খনা-মিহিরের মূড়া (Mound of Khona-Mihir) নামে পরিচিত কিছু কিছু ঐতিহাসিক মূড়াটিকে গুপ্ত যুগের মন্দির হিসেবে অনুমান করলেও মন্দিরের পক্ষে জোড়ালো কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি এখানে

এক বাঙ্গালী নারীর গৌরব যাত্রা

কিন্তু প্রাচীন এই ধ্বংসস্তুপের সাথে খনার নাম কেন জড়িত? খনা তো বেঁচে আছে শুধু তার ছন্দোময় জ্ঞানকথায়: আবহাওয়া, কৃষিকাজ, জ্যোতিষী শাস্ত্রে, আর কিছু ছন্দে যা তুলে ধরে তার শ্বশুর বরাহমিহিরের বুদ্ধির সীমাবদ্ধতা আসলে কে সে?

অনেক কথাই হয়তো বলা যায় কিন্তু আমার ভাবতে খুব ভালো লাগে সেই কবে, পুরাকালে, বাঙ্গালী এক নারীর গৌরব-যাত্রা, বাংলার গৌড় থেকে বীরচম্পা হয়ে ভারতের অবন্তীতে, চারপাশে রেখে যাওয়া চোখ ধাঁধানো বাস্তবজ্ঞান আর মন মাতানো ছন্দ

তারপর, সে এক বিষাদ গাঁথা, জ্ঞানের ছটা সহ্য করতে না পেরে তাকে বোবা-স্তব্ধ করে দিতে ঈর্ষাপরায়ণ কুচক্রীদের হীন বীভস ষড়যন্ত্র! কিন্তু কে কবে পেরেছে তা? কুচক্রীর দল মারা গেছে সেই কবে, বেঁচে আছে খনা, বেঁচে আছে তার কন্ঠ:

কলা-রুয়ে কেটো না পাত,

তাতে কাপড় তাতেই ভাত

খনার উপাখ্যানে রাক্ষস সম্প্রদায়ের কথা শুনে একে নিছক পুরাকালের পরমকথা বলে হেসে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই গঙ্গার তীরে বাংলার দুর্ধর্ষ গঙ্গারিধি জাতি বহুবার থামিয়ে দিয়েছিল বহিরাগত শত্রুর বিজয় অভিযান, পরাক্রমশালী আলেকজান্ডার সাহসই করেননি এই এলাকায় অভিযানের, আর্যরাও ঢুকতে পারেনি বহুকাল, আর তাই বহি:শত্রুরা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে অপমান-ক্ষোভে প্রায়ই বাংলার মানুষকে তাদের সাহিত্যে আখ্যা দিয়েছে রাক্ষস, দানব, বানর হিসেবে
রীশ্রী ঠাকুর রামচন্দ্র দেব-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী


বাংলাদেশের তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা বর্তমানে শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার ডিঙ্গামানিক গ্রামে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে এই রহস্যময় মহামানব পরমগুরু কৈবল্যপ্রাপ্ত শ্রীশ্রী রামঠাকুর আবির্ভূত হন। তিনি ১২৬৬ বাংলার ২১ মাঘ, ১৮৬০ ইংরেজির ২ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, সকাল ৯/১০ ঘটিকার সময় শুক্লাদশমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রে রাঢ়ীয় ভরদ্বাজ গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ভূমিষ্ঠ হওয়ার বৃত্তান- অত্যন- প্রহেলিকাময়, অলৌকিকতা ও বৈচিত্র্যে ভরপুর।

শ্রী ঠাকুরের পিতা রাধামাধব চক্রবর্তী অত্যন- সরল প্রকৃতির ও ঐকান্তিক ধর্মনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি একজন প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক ও নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁর কুলগুরু ছিলেন সিদ্ধতন্ত্রাচার্য মৃত্যুঞ্জয় ন্যায়পঞ্চানন। তাঁর সাধনক্ষেত্র "পঞ্চবটী”এখনও তাঁদের বড়ির পূর্বপার্শ্বে বিদ্যমান। তিনি সারাজীবন নিরামিষভোজী ছিলেন। তিনি শীতকালের কনকনে ঠাণ্ডা সহ্য করার অদ্ভুত শক্তি অর্জন করেছিলেন। এই তান্ত্রিকসাধক মাঘ মাসের ভয়ানক শীতের রাত্রিতেও পুকুরের জলে দাঁড়িয়ে আহ্নিক করতেন। শ্রীশ্রী ঠাকুরের মাত্র ৮ বৎসর বয়সে ১২৭৩ বাংলা সনে প্রায় ৫০ বৎসর বয়সে তিনি স্বর্গারোহণ করেন। পিতার মৃত্যুতে শ্রীশ্রী ঠাকুরের শিশুকালকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়।

শ্রীশ্রী ঠাকুরের জননী শ্রীমতী কমলাদেবী ছিলেন অতিশয় পুণ্যবতী, সহজ-সরলা, উদার ও পরোপকারী। ধর্মে তাঁর ভক্তিপরায়ণতা ও ঐকানি-কতার জন্য সুখ্যাতি ছিল। তিনি কৃচ্ছ্রসাধন ও ব্রতাদি পালনে সদা-সতর্ক থাকতেন। তিনি নিজের সুখ-সুবিধার কথা চিন্তা না করে পরের সুখ-সুবিধার প্রতি লক্ষ রাখতেন বেশি। তিনি ১৩১০ বাংলার জ্যৈষ্ঠ মাসে ১৯০৩ ইং সালে স্বর্গারোহণ করেন।


শ্রীশ্রী ঠাকুরের পৈত্রিক আদিনিবাস ছিল ফরিদপুরের (দক্ষিণ বিক্রমপুরের) জপ্‌সা গ্রামে। জপ্‌সা গ্রামটি ডিঙ্গামানিক থেকে উত্তর-পশ্চিমে প্রায় দশ মাইল দূরে অবসি'ত। নানা কারণে জপ্‌সা গ্রামের সুখ্যাতি ছিল। বিদ্যালঙ্কার পরিবার ছিল সেই গ্রামের এক বিখ্যাত ব্রাহ্মণ পরিবার। রাধামাধব চক্রবর্তীর পিতার নাম ছিল রামজয় চক্রবর্তী। তিনি জপ্‌সা গ্রামে পরলোকগমন করেন। পদ্মার শাখানদী কীর্তিনাশার করাল গ্রাসে বাপদাদার ভিটেমাটি নিশ্চিহ্ন হওয়ার কারণে শ্রীশ্রী ঠাকুরের পিতা রাধামাধবকে জপ্‌সা গ্রাম ছেড়ে চলে আসতে হল ডিঙ্গামানিক গ্রামে। সেখানে তিনি কমলাদেবীর পাণিগ্রহণ করে বসবাস শুরু করেন।


শ্রীশ্রী ঠাকুরের মাতা কমলাদেবীর পিতামহ শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য ছিলেন একজন প্রখ্যাত শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত। তৎকালীন রাজা রাজবল্লভের প্রতিষ্ঠিত রাজনগরের দ্বারপণ্ডিত ছিলেন তিনি। তৎকালীন যুগের প্রথানুসারে রাজা থেকে পুরস্কারস্বরূপ ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি লাভ করেন পণ্ডিত কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়। ওয়ারিশ সূত্রে উক্ত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশের মালিক হন তাঁরই জ্যৈষ্ঠপুত্র সদানন্দ ভট্টাচার্য। তিনি স্বর্গারোহণ করলে উক্ত সম্পত্তির অধিকারী হন তাঁরই একমাত্র কন্যাসন্তান কমলাদেবী।


শ্রীশ্রী ঠাকুরের যমজভাই লক্ষ্মণসহ চার ভাই ও এক ভগ্নী ছিলেন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা কালীকুমার ছিলেন ধর্মপরায়ণ ও পরোপকারী ব্যক্তি। যৌবন বয়সে তিনি কঠিন বাতরোগে আক্রান- হয়ে পিতার চেষ্টায় মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলেও পা দুইটি শুকিয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তিনি ঈশ্বরের হাতে নিজেকে সমর্পণ করে পূজার্চনা নিয়ে পড়ে থাকতেন। দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠভ্রাতা জগবন্ধু ছিলেন অতিশয় সরল ও উদার প্রকৃতির লোক। তিনি ১৩৩৩ বাংলার ২৪ ভাদ্র তারিখে পরলোকগমনের সময় শ্রীশ্রী ঠাকুর উপসি'ত থেকে অনে-্যষ্ঠিক্রিয়ায় যোগ দেন। শ্রীশ্রী ঠাকুরের যমজ কনিষ্ঠ সহোদর লক্ষ্মণ ঠাকুর ছিলেন পরোপকারী, কষ্টসহিষ্ণু, ধর্মপ্রেমভক্তিসম্পন্ন মহৎচরিত্রের অধিকারী। হরিনাম শ্রবণে তাঁর শরীর রোমাঞ্চিত ও পুলকিত হয়ে আত্ম্নসংবরণ করতে না পেরে সর্বশরীর কাঠের মত শক্ত ও চক্ষু পলকহীন অবস'ায় সি'র হয়ে থাকত। অকৃতদার লক্ষ্মণ ঠাকুর আর্তপীড়িতের সেবায় সবসময় উন্মুখ হয়ে থাকতেন। তিনি প্রায় ৫৭/৫৮ বৎসর বয়সে কলেরা রোগে আক্রান- হয়ে দেহত্যাগ করেন। শ্রীশ্রী ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা একমাত্র ভগ্নী কশীমণি দেবী ছিলেন অত্যন- সহজ-সরল ও মধুর স্বভাবের। তাঁর মধুর ব্যবহারের জন্য সবাই তাঁকে ভালোবাসতেন।


শ্রীশ্রী ঠাকুরের বিদ্যাশিক্ষার ব্যাপারে মাতা-পিতার যত্নের কোন ত্রুটি ছিল না। সুযোগ-সুবিধার অভাবও ছিল না। কার্তিকপুরের মুসলমান জমিদার বাড়ির সামনে তৎকালে একটি মাধ্যমিক ইংরেজি বিদ্যালয় ছিল যা পরবর্তীতে কার্তিকপুর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সেই বিদ্যালয়ে শ্রীশ্রী ঠাকুরকে ভর্তি করা হল। কিন' তিনি অন্যান্য বালকের ন্যায় স্কুলে যাতায়াত করলেও বিদ্যাশিক্ষা বিষয়ে তাঁর তেমন কোন আগ্রহ ছিল না। এই অনাগ্রহের কারণে পরবর্তীতে তিনি আর বিদ্যালয়ে শিক্ষাগ্রহণ করেন নি।


বাল্যকালে শ্রীশ্রী ঠাকুর অন্যান্য বালকের ন্যায় খেলাধুলায় মত্ত থাকলেও অন্যান্য বালকের মত তিনি চঞ্চল ছিলেন না। ধৈর্য, সৈ'র্য ও গাম্ভীর্যের চরিত্র ফুটে উঠত তাঁর ভিতর। ছোট-বড় সকলেই তাঁরই সরলতা, মৃদু আলাপি ও সুমধুর ব্যবহারে মুগ্ধ হত। তিনি বাল্যকাল থেকে অতিশয় কষ্টসহিষ্ণু, অধ্যবসায়ী ও ধর্মপরায়ণ ছিলেন। মাতা-পিতা, ভাই-বোন, পাড়া-প্রতিবেশীসহ গুরুজনদের প্রতি তিনি একান- শ্রদ্ধাপরায়ণ ও অনুগত ছিলেন। তিনি সংসারের অতিশয় কষ্টসাধ্য কাজগুলো নির্বিকার চিত্তে সম্পন্ন করতেন। বাল্যখেলাতে সমবয়সীদের নিয়ে মৃত্তিকার দেব-দেবীর মূর্তি তৈরি করে কীর্তনে নেচে-গেয়ে পরমানন্দে পূজার্চনা করতেন। পারমাত্মিক সংগীতের প্রতি প্রচণ্ড দুর্বলতা ছিল। তৎকালে সেই অঞ্চলে রামায়ণ গান শুনতে যেতেন বিভিন্ন জায়গায় গানের আসরে। শ্রীশ্রী ঠাকুর একসময় মাকে বললেন, ‘‘মা, রামায়ণ গানে কেবল আমার ও লক্ষ্মণের কথাই তো বলে”। তিনি শ্রীমদ্ভাগবত, পুরাণ ইত্যাদি ধর্মগ্রন'পাঠ মনোযোগ সহকারে শুনে হুবহু বলার ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন। তিনি শ্যামাসংগীত খুব ভালবাসতেন। কেহ ভক্তিগীতি গাইলেই তন্ময় হয়ে শুনতেন। তিনি বাইরের যাবতীয় কাজকর্ম করলেও চিত্ত ছিল অন-র্জগতে।


শ্রীশ্রী ঠাকুরের পিতৃদেবের স্বর্গারোহণ এবং কিছুকাল পরে তাঁর পিতার গুরুদেব মৃত্যুঞ্জয় ন্যায়পঞ্চানন-এর দেহত্যাগ বালক রামচন্দ্র দেব-এর জীবনে নিয়ে আসে এক পারমাত্মিক পরিবর্তন। তিনি হয়ে গেলেন উদাস, নীরব, নিথর। তাঁর এই ভাবান-রে অভিভাবকসহ স্থানীয় সকলকে ভাবিয়ে তুলল। নয় বৎসর বয়সের রামের এই ভাবান-রের কথা চিন্তা করে কেউ কেউ মনে করলেন, শাস্ত্রানুসারে উপনয়ন সংস্কার হলে হয় তো মতিগতির পরিবর্তন হতে পারে। শ্রীশ্রী ঠাকুরের জ্যেষ্ঠভ্রাতা কালীকুমার চক্রবর্তী ‘‘আচার্য”হয়ে রাম-লক্ষ্মণ-এর উপনয়ন-সংস্কার সম্পন্ন করলেন। তৎকালীন সমাজে উপনয়নের পূর্বে পঞ্চগব্য খাওয়ার ব্যবস্থানুযায়ী তাঁদেরও পঞ্চগব্য ভক্ষণ করালেন। সেইদিনই ঠাকুর চিরদিনের মত ত্যাগ করলেন অন্ন্‌। যদিও দু'একবার ব্যতিক্রম হয়েছে, তা কেবল মা-জননী ও বিশেষ ভক্তদের অনুরোধে। কিন' সে অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে অসুস' হয়েছেন বারে বারে। উপনয়নের পর মা কমলাদেবীকে নিয়ে দণ্ড ভাসানোর সময় দর্শন হল এক সৌম্য সন্ন্যাসীর। তিনি অপলক দৃষ্টিতে রামের দিকে তাকিয়ে মা কমলাদেবীকে প্রার্থনা নিবেদন করে বললেন, ‘‘তোমার এ ছেলেটি আমাকে দিয়ে দাও”। একি! আবার অলক্ষুনে কথা? রাম যে আমার নয়নের মণি। এমন ছেলেকে কি কেউ সন্ন্যাসীর হাতে তুলে দেয়! সেইদিন সন্ন্যাসী রিক্তহসে- ফিরে গেলেও তাঁর গহীন অন-রে গ্রথিত হয়ে রইল রাম-তনু।


উপনয়নের পর প্রব্রজ্যাসক্ত মনের উপসম না হয়ে বরং গড়ে উঠল প্রকৃতির সংগে নিবিড় নৈকট্য। অসীম আকাশে মুক্তালয়ে যেন গৈরিক আলোকবর্তিকা হাতছানি দিয়ে আহ্বান করছে। রাম এখন গায়ত্রীমন্ত্র জপের মধ্য দিয়ে আহ্নিক নিয়ে পড়ে থাকেন। এই জপের জ্যোতিতে রাম এক ঐশ্বরীয় শক্তির আবেশে উদ্ভাসিত হতে থাকেন। অলৌকিক নিয়ন্তার আবাহনে চলে যেন তাঁর সমর্পিত জীবন। অন-রাত্মার মধ্যে যেন এক অনির্বাণ জ্যোতি স্ফুরিত হয়ে ভগবদ্‌ধামে নিজেকে লয় করিয়ে নিচ্ছেন।


পিতৃদেবের দেহত্যাগের পর প্রায় চার বৎসর অতিবাহিত হল। এমনি এক সময়ে রামের জীবনে এল শুভ লগন। যথারীতি বালক রাম রাত্রিতে পরম শানি-তে গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। হঠাৎ স্বপ্নযোগে তাঁর সমনে উদ্ভাসিত হল সৌম্য, শান- এক সন্ন্যাসী। কানের কাছে সন্ন্যাসী বীজমন্ত্র উচ্চারণ করে বললেন, ‘‘বৎস! প্রতিদিন নিবিষ্টমনে এই শক্তিমন্ত্র জপ করে যাও, মুক্তির পথ তোমার অচিরেই উন্মুক্ত হয়ে যাবে”। স্বপ্নশ্রুত মন্ত্রের অমোঘ প্রভাবে বালক রামের অন-র্জীবনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন-র্লীন এক মহাশক্তি জন্মান-রের সাত্ত্বিক সংস্কাররূপে প্রকট হয়ে ধ্যানস্রোতে বিকশিত হতে থাকে। বালক রাম প্রচ্ছন্নে থাকতে চাইলেও দৈবীকৃপাপ্রাপ্ত ঐশ্বরীয় প্রসাদের নতুন স্বরূপটি ক্রমে বাড়ির লোকের কাছে প্রকাশ হতে থাকে।


প্রায় বার বৎসর বয়সে শ্রীশ্রী ঠাকুর তাঁর এক দূর সম্পর্কের পিসিমাকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার চন্দ্রনাথ তীর্থ পরিভ্রমণ, অর্থ উপার্জনের জন্য বাংলাদেশের ফেনী শহরে এক উকিলবাবুর বাসায় পাচকবৃত্তির সময়, উকিলবাবুর আয়োজিত কালীপূজায় অলৌকিক ঘটনাসহ অসংখ্য বিভূতি প্রকাশ হয়ে পড়লে রাম লোকালয়ের বিভিন্ন এলাকায় নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে এক স্বপ্নীল আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ করে দিনাতিপাত করতে থাকেন।


পারমাত্মিক জগতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করার মানসে, অন-রের অরুন'দ আর্তিতে, ইচ্ছাহীন এক অভিলাষে ঐশীশক্তির সাথে পরম পুনর্মিলনের এক দুর্নিবার আকর্ষণে কণ্টাকাকীর্ণ ঘনঅরণ্য গিরিসঙ্কট আচ্ছাদিত বহু পথ অতিক্রমে বালক রাম পৃথিবীর অন্যতম মহাশক্তির আধার শক্তিপীঠ কামরূপ কামাখ্যার তীর্থপীঠে বাৎসরিক অম্বুবাচির উৎসবে দৈবিক তৃষিত-মর্মর-হৃদয় আকাঙ্ক্ষিত মহালগনের অপেক্ষায় জপরত ছিলেন। এই মহাতীর্থে শ্রীশ্রী ঠাকুরের সাথে তাঁর গুরুদেব ‘‘শ্রীঅনঙ্গদেব”-এর সাথে প্রথম সশরীরে সাক্ষাৎ হয়। গুরুর সাথে সাক্ষাৎ পরবর্তীতে শ্রীশ্রী ঠাকুর আনুষ্ঠানিক দীক্ষাপ্রাপ্ত হন এবং হিমালয় পরিভ্রমণ শুরু হয়।


তপস্যাপুত হিমালয় পরিভ্রমণের সময় তাঁর গুরুদেবের অতিপ্রাকৃত অলৌকিক শক্তির কৃপাবলে অসংখ্য অতিপ্রাকৃত সাধনক্ষেত্র, সিদ্ধপীঠ, রহস্যময় দেব-দেবী, বহু ব্রহ্মবিদ্‌ মহাপুরুষের দুর্লভ সান্নিধ্যলাভ করে নিজেকে পরিপূর্ণ এক ব্রহ্মবিদ হিসেবে ধরাধামে পারমাত্মিক লীলার অমৃতধারা প্রবাহিত করার নিয়তির এক অদম্য ইচ্ছার প্রতিফলনে ঐশীশক্তির মহামিলনের এক মহাদায়িত্ব নিয়ে তিনি লোকালয়ে ফিরে আসেন।


গুরুদেব-এর স্বরূপ সত্তার ছোঁয়ায় উজ্জীবিত হয়ে শ্রীশ্রী ঠাকুর সাধনজগতের বৈচিত্রিক লীলাকে তাঁর পরিভ্রমণের পাথেয় করে নিলেন এবং গুরুর আদেশকে শিরোধার্য করে পাপভারাক্রান- বেদনার পঙ্কিলে আবর্তিত জীবকে পরমানন্দের পরমাত্মায় মহামিলনের এক অব্যর্থ পরিব্রাজনে নিজেকে উৎসর্গ করলেন। সেই থেকেই তিনি পৃথিবীর অন্যতম সাধনপীঠ ও মহাসাধকদের পদচারণায় ধন্য অবিভক্ত ভারতের একটা বিশেষ অংশে বিভিন্নভাবে অবহেলিত মানবতার মানবিকতাকে জাগ্রত করার মানসে তাঁর অভিযাত্রা শুরু করেন। তিনি মানবিকতার পঙ্কিল আবর্তে নিমজ্জিত মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে মানবতার আধ্যাত্মিক মহামুক্তিতে কৈবল্যপ্রাপ্তির জন্য ‘‘শ্রীনাম”বিতরণ শুরু করেন। ‘‘কলিকালে মহামন্ত্রই একমাত্র জীবাত্মা ও পরমাত্মার মহামিলনের পথ”এটাই শ্রীশ্রী ঠাকুরের অন্যতম বেদবাণী।


তিনি আবির্ভাব থেকে তিরোধান পর্যন- অসংখ্য পারমার্থিক লীলার বিচ্ছুরিত আলোতে অধঃপতিত মানবতাকে তাঁর ব্রহ্মবিদ্‌স্বরূপ প্রকাশ করে মানবতার আধ্যাত্মিক মুক্তির পথকে আরও সুগম করে দিয়ে গেছেন। তাঁর জীবনটাই ছিল অন-হীন লীলার ভাণ্ডার। তাঁর দেহত্যাগের বর্তমান প্রায় ৫০ বৎসর পরও ঐকানি-ক ভক্তদের সাথে প্রতিনিয়ত ঐশ্বরিক শক্তির দৈবলীলার আলোতে প্রকটভাবে নিজেকে অম্লান করে রেখেছেন।


শ্রীশ্রী ঠাকুরের আদর্শকে লালন ও ধারণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য একনিষ্ঠ ভক্তরা ‘‘শ্রীনাম”-এর মহাশক্তিকে অবলম্বন করে তাদের নিত্য-জীবনকে কলুষমুক্ত করার মাধ্যমে পারমাত্মিক জীবনের মহালয়ে আবৃত হওয়ার অদম্য আর্তিতে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্রীশ্রী কৈবল্যনাথের পরমকৃপার পরশে রামভক্তসহ সকল মানবাত্মা তাদের জীবন-চলার পথকে রামময় করে আনন্দলোকে উদ্ভাসিত হওয়ার অদম্য ইচ্ছায় কাজ করে যাচ্ছে।


দীর্ঘ প্রায় ৯০ বৎসরের জীবনের অসংখ্য প্রকটলীলার ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে সকল ধরনের বৈষম্যহীন, কুসংস্কারমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে মানবতার মানবিক গুণাবলিকে জাগ্রত করে মানবতার আধ্যাত্মিক মুক্তির পথকে সুগম করার অভিপ্রায়ে শ্রীশ্রী ঠাকুরের আলোকিত জীবনের আলোকবর্তিকার বিচ্ছুরিত আলোতে বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার চৌমুহনী এলাকায় তাঁর ঐকানি-ক ভক্ত উপেন্দ্র সাহার বাংলোতে ১৩৫৬ বাংলার ১৮ বৈশাখ ১৯৪৯ ইং সালের ১ মে, রবিবার, বেলা ১.৩০ মি. সময় পুণ্য অক্ষয়তৃতীয়া তিথির মাহেন্দ্রক্ষণে সত্যের পূজারি মহাসাধক শ্রীশ্রী ঠাকুর রামচন্দ্র দেব লক্ষ লক্ষ ভক্তপ্রাণকে নয়নের জলে ভাসিয়ে মহাপ্রয়াণ করলেন। তিনি যে কক্ষে দেহত্যাগ করলেন সেখানে তাঁর সমাধিক্ষেত্র নির্ধারিত হয় এবং সেখানে অপরূপ স'াপত্যশৈলীতে অনিন্দ্যসুন্দর সমাধিমন্দির বর্তমানে বিদ্যমান। প্রতি বছর সেখানে তিরোধান দিবসে অক্ষয়তৃতীয়া তিথিতে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগমে আনন্দময় পরিবেশে এক বিশাল মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিনিয়ত অসংখ্য ভক্তপ্রাণ মানুষ শ্রীশ্রী ঠাকুেরর শ্রীচরণে সমর্পিত হয়ে ত্রিতাপজ্বালা মোচনের এক অদম্য বাসনায় সমাধিক্ষেত্র দর্শন করেই চলেছেন। জয় রাম, জয় গোবিন্দ।
                                       শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত //////////১১ তৃতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ৫ই অগস্ট

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ — জ্ঞানযোগ বা বেদান্ত বিচার

বিদ্যাসাগর মহাপণ্ডিত। যখন সংস্কৃত কলেজে পড়িতেন, তখন নিজের শ্রেণীর সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্র ছিলেন। প্রতি পরীক্ষায় প্রথম হইতেন ও স্বর্ণপদকাদি (Medal) বা ছাত্রবৃত্তি পাইতেন। ক্রমে সংস্কৃত কলেজের প্রধান অধ্যাপক হইয়াছিলেন। তিনি সংস্কৃত ব্যাকারণ ও সংস্কৃত কাব্যে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন। অধ্যবসায় গুণে নিজে চেষ্টা করিয়া ইংরেজী শিখিয়াছিলেন।

ধর্ম-বিষয়ে বিদ্যাসাগর কাহাকেও শিক্ষা দিতেন না। তিনি দর্শনাদি গ্রন্থ পড়িয়াছিলেন। মাস্টার একদিন জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, “আপনার হিন্দুদর্শন কিরূপ লাগে?” তিনি বলিয়াছিলেন, “আমার তো বোধ হয়, ওরা যা বুঝতে গেছে, বুঝাতে পারে নাই।” হিন্দুদের ন্যায় শ্রাদ্ধাদি ধর্মকর্ম সমস্ত করিতেন, গলায় উপবীত ধারণ করিতেন, বাঙলায় যে-সকল পত্র লিখিতেন, তাহাতে ‘শ্রীশ্রীহরিশরনম্‌’ ভগবানের এই বন্দনা আগে করিতেন।

মাস্টার আর একদিন তাঁহার মুখে শুনিয়াছিলেন, তিনি ঈশ্বর সম্বন্ধে কিরূপ ভাবেন। বিদ্যাসাগর বলিয়াছিলেন, “তাঁকে তো জানবার জো নাই! এখন কর্তব্য কি? আমার মতে কর্তব্য, আমাদের নিজের এরূপ হওয়া উচিত যে, সকলে যদি সেরূপ হয়, পৃথিবী স্বর্গ হয়ে পড়বে। প্রত্যেকের চেষ্টা করা উচিত যাতে জগতের মঙ্গল হয়।”

বিদ্যা ও অবিদ্যার কথা কহিতে কহিতে ঠাকুর ব্রহ্মজ্ঞানের কথা কহিতেছেন। বিদ্যাসাগর মহাপণ্ডিত। ষড় দর্শন পাঠ করিয়া দেখিয়াছেন, বুঝি ঈশ্বরের বিষয় কিছুই জানা যায় না।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ব্রহ্ম — বিদ্যা ও অবিদ্যার পার। তিনি মায়াতীত।

Problem of Evil — ব্রহ্ম নির্লিপ্ত — জীবেরই সম্বন্ধে দুঃখাদি

“এই জগতে বিদ্যামায়া অবিদ্যামায়া দুই-ই আছে; জ্ঞান-ভক্তি আছে আবার কামিনী-কাঞ্চনও আছে, সৎও আছে, অসৎও আছে। ভালও আছে আবার মন্দও আছে। কিন্তু ব্রহ্ম নির্লিপ্ত। ভাল-মন্দ জীবের পক্ষে, সৎ-অসৎ জীবের পক্ষে, তাঁর ওতে কিছু হয় না।

“যেমন প্রদীপের সম্মুখে কেউ বা ভাগবত পড়ছে, আর কেউ বা জাল করছে। প্রদীপ নির্লিপ্ত।

“সূর্য শিষ্টের উপর আলো দিচ্ছে, আবার দুষ্টের উপরও দিচ্ছে।

“যদি বল দুঃখ, পাপ, অশান্তি — এ-সকল তবে কি? তার উত্তর এই যে, ও-সব জীবের পক্ষে। ব্রহ্ম নির্লিপ্ত। সাপের ভিতর বিষ আছে, অন্যকে কামড়ালে মরে যায়। সাপের কিন্তু কিছু হয় না।

ব্রহ্ম অনির্বচনীয় অব্যপদেশ্যম্‌ — The Unknown and Unknowable

“ব্রহ্ম যে কি, মুখে বলা জায় না। সব জিনিস উচ্ছিষ্ট হয়ে গেছে। বেদ, পুরাণ, তন্ত্র, ষড় দর্শন — সব এঁটো হয়ে গেছে! মুখে পড়া হয়েছে, মুখে উচ্চারণ হয়েছে — তাই এঁটো হয়েছে। কিন্তু একটি জিনিস কেবল উচ্ছিষ্ট হয় নাই, সে জিনিসটি ব্রহ্ম। ব্রহ্ম যে কি, আজ পর্যন্ত কেহ মুখে বলতে পারে নাই।”

বিদ্যাসাগর (বন্ধুদের প্রতি) — বা! এটি তো বেশ কথা! আজ একটি নূতন কথা শিখলাম।

শ্রীরামকৃষ্ণ — এক বাপের দুটি ছেলে। ব্রহ্মবিদ্যা শিখবার জন্য ছেলে দুটিকে, বাপ আচার্যের হাতে দিলেন। কয়েক বৎসর পরে তারা গুরুগৃহ থেকে ফিরে এল, এসে বাপকে প্রণাম করলে। বাপের ইচ্ছা দেখেন, এদের ব্রহ্মজ্ঞান কিরূপ হয়েছে। বড় ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাপ! তুমি তো সব পড়েছ, ব্রহ্ম কিরূপ বল দেখি?” বড় ছেলেটি বেদ থেকে নানা শ্লোক বলে বলে ব্রহ্মের স্বরূপ বুঝাতে লাগল! বাপ চুপ করে রইলেন। যখন ছোট ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, সে হেঁটমুখে চুপ করে রইল। মুখে কোন কথা নাই। বাপ তখন প্রসন্ন হয়ে ছোট ছেলেকে বললেন, “বাপু! তুমি একটু বুঝেছ। ব্রহ্ম যে কি। মুখে বলা যায় না।”

“মানুষ মনে করে, আমরা তাঁকে জেনে ফেলেছি। একটা পিঁপড়ে চিনির পাহাড়ে গিছল। এক দানা খেয়ে পেট ভরে গেল, আর এক দানা মুখে করে বাসায় যেতে লাগল, যাবার সময় ভাবছে — এবার এসে সব পাহাড়টি লয়ে যাব। ক্ষুদ্র জীবেরা এই সব মনে করে। জানে না ব্রহ্ম বাক্যমনের অতীত।

“যে যতই বড় হউক না কেন, তাঁকে কি জানবে? শুকদেবাদি না হয় ডেও-পিঁপড়ে — চিনির আট-দশটা দানা না হয় মুখে করুক।”

ব্রহ্ম সচ্চিদানন্দস্বরূপ — নির্বিকল্পসমাধি ও ব্রহ্মজ্ঞান

“তবে বেদে, পুরাণে যা বলছে — সে কিরকম বলা জান? একজন সাগর দেখে এলে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, কেমন দেখলে, সে লোক মুখ হাঁ করে বলে, — ‘ও! কি দেখলুম! কি হিল্লোল কল্লোল!’ ব্রহ্মের কথাও সেইরকম। বেদে আছে — তিনি আনন্দস্বরূপ — সচ্চিদানন্দ। শুকদেবাদি এই ব্রহ্মসাগর তটে দাঁড়িয়া দর্শন স্পর্শন করেছিলেন। এক মতে আছে — তাঁরা এ-সাগরে নামেন নাই। এ-সাগরে নামলে আর ফিরবার জো নাই।

“সমাধিস্থ হলে ব্রহ্মজ্ঞান হয়; ব্রহ্মদর্শন হয় — সে অবস্থায় বিচার একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, মানুষ চুপ হয়ে যায়। ব্রহ্ম কি বস্তু মুখে বলবার শক্তি থাকে না।

“লুনের ছবি (লবণ পুত্তলিকা) সমুদ্র মাপতে গিছল। (সকলের হাস্য) কত গভীর জল তাই খপর দেবে। খপর দেওয়া আর হল না। যাই নামা অমনি গলে যাওয়া। কে আর খপর দিবেক?”

একজন প্রশ্ন করিলেন, “সমাধিস্থ ব্যক্তি, যাঁহার ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে তিনি কি আর কথা কন না?”

শ্রীরামকৃষ্ণ (বিদ্যাসাগরাদির প্রতি) — শঙ্করাচার্য লোকশিক্ষার জন্য বিদ্যার ‘আমি’ রেখেছিলেন। ব্রহ্মদর্শন হলে মানুষ চুপ করে যায়। যতক্ষণ দর্শন না হয়, ততক্ষণই বিচার। ঘি কাঁচা যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই কলকলানি। পাকা ঘির কোন শব্দ থাকে না। কিন্তু যখন পাকা ঘিয়ে আবার কাঁচা লুচি পড়ে, তখন আর একবার ছ্যাঁক কলকল করে। যখন কাঁচা লুচিকে পাকা করে, তখন আবার চুপ হয়ে যায়। তেমনি সমাধিস্থ পুরুষ লোকশিক্ষা দিবার জন্য আবার নেমে আসে, আবার কথা কয়।

“যতক্ষণ মৌমাছি ফুলে না বসে ততক্ষণ ভনভন করে। ফুলে বসে মধু পান করতে আরম্ভ করলে চুপ হয়ে যায়। মধুপান করবার পর মাতাল হয়ে আবার কখন কখন গুনগুন করে।

“পুকুরে কলসীতে জল ভরবার সময় ভকভক শব্দ হয়। পূর্ণ হয়ে গেলে আর শব্দ হয় না। (সকলের হাস্য) তবে আর এক কলসীতে যদি ঢালাঢালি হয় তাহলে আবার শব্দ হয়।” (হাস্য)                              
আসুন জেনে নেই শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম হরে কৃষ্ণ- আজ জন্মাষ্টমিতে সবাইকে ফুলেল শুভেচ্ছা
আসুন পড়েফেলি শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম

জয় জয় গোবিন্দ গোপাল গদাধর।
কৃষ্ণচন্দ্র কর দয়া করুণাসাগর।।
জয় রাধে গোবিন্দু গোপাল বনমালী।
শ্রীরাধার প্রাণধন মুকন্দ মুরারি।।
হরিনাম বিনে রে গোবিন্দু নাম বিনে।
বিফলে মনুষ্য জন্ম যায় দিনে দিনে।।
দিন গেল মিছে কাজে রাত্রি গেল নিদ্রে।
না ভজিনু রাধাকৃষ্ণ চরণার বিন্দে।।
কৃষ্ণ ভজিবার তরে সংসারে আইনু।
মিছে মায়ায় বদ্ধ হ’য়ে বৃক্ষসম হৈনু।।
ফলরূপে পুত্র কন্যা ডাল ভাঙ্গি পড়ে।
কালরূপে সংসারেতে পক্ষী বাসা করে।।
যখন কৃষ্ণ জন্ম নিল দৈবকী উদরে।
মথুরাতে দেবগণ পুষ্পবৃষ্টি করে।।
বসুদেব রাখি এলো নন্দের মন্দিরে।
নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে দিনে বাড়ে।।
শ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন।১
যশোদা রাখিল নাম যাদু বাছাধন।।২
উপানন্দ নাম রাখে সুন্দর গোপাল।৩
ব্রজবালক নাম রাখে ঠাকুর রাখাল।।৪
সুবল রাখিল নাম ঠাকুর কানাই।৫
শ্রীদাম রাখিল নাম রাখাল রাজা ভাই।।৬
ননীচোরা নাম রাখে যতেক গোপিনী।৭
কালসোনা নাম রাখে রাধা-বিনোদিনী।।৮
কুজ্বা রাখিল নাম পতিত-পাবন হরি।৯
চন্দ্রাবলী নাম রাখে মোহন বংশীধারী।।১০
অনন্ত রাখিল নাম অন্ত না পাইয়া।১১
কৃষ্ণ নাম রাখেন গর্গ ধ্যানেতে জানিয়া।।১২
কন্বমুনি নাম রাখে দেব চক্রপাণী।১৩
বনমালী নাম রাখে বনের হরিণী।।১৪
গজহস্তী নাম রাখে শ্রীমধুসূদন।১৫
অজামিল নাম রাখে দেব নারায়ন।।১৬
পুরন্দর নাম রাখে দেব শ্রীগোবিন্দ।১৭
দ্রৌপদী রাখিল নাম দেব দীনবন্ধু।।১৮
সুদাম রাখিল নাম দারিদ্র-ভঞ্জন।১৯
ব্রজবাসী নাম রাখে ব্রজের জীবন।।২০
দর্পহারী নাম রাখে অর্জ্জুন সুধীর।২১
পশুপতি নাম রাখে গরুড় মহাবীর।।২২
যুধিষ্ঠির নাম রাখে দেব যদুবর।২৩
বিদুর রাখিল নাম কাঙ্গাল ঈশ্বর।।২৪
বাসুকি রাখিল নাম দেব-সৃষ্টি স্থিতি।২৫
ধ্রুবলোকে নাম রাখে ধ্রুবের সারথি।।২৬
নারদ রাখিল নাম ভক্ত প্রাণধন।২৭
ভীষ্মদেব নাম রাখে লক্ষ্মী-নারায়ণ।।২৮
সত্যভামা নাম রাখে সত্যের সারথি।২৯
জাম্বুবতী নাম রাখে দেব যোদ্ধাপতি।।৩০
বিশ্বামিত্র নাম রাখে সংসারের সার।৩১
অহল্যা রাখিল নাম পাষাণ-উদ্ধার।।৩২
ভৃগুমুনি নাম রাখে জগতের হরি।৩৩
পঞ্চমুখে রাম নাম গান ত্রিপুরারি।।৩৪
কুঞ্জকেশী নাম রাখে বলী সদাচারী।৩৫
প্রহ্লাদ রাখিল নাম নৃসিংহ-মুরারী।।৩৬
বশিষ্ঠ রাখিল নাম মুনি-মনোহর।৩৭
বিশ্বাবসু নাম রাখে নব জলধর।।৩৮
সম্বর্ত্তক নাম রাখে গোবর্দ্ধনধারী।৩৯
প্রাণপতি নাম রাখে যত ব্রজনারী।।৪০
অদিতি রাখিল নাম আরতি-সুদন।৪১
গদাধর নাম রাখে যমল-অর্জুন।।৪২
মহাযোদ্ধা নাম রাখি ভীম মহাবল।৪৩
দয়ানিধি নাম রাখে দরিদ্র সকল।।৪৪
বৃন্দাবন-চন্দ্র নাম রাখে বিন্দুদূতি।৪৫
বিরজা রাখিল নাম যমুনার পতি।।৪৬
বাণী পতি নাম রাখে গুরু বৃহস্পতি।৪৭
লক্ষ্মীপতি নাম রাখে সুমন্ত্র সারথি।।৪৮
সন্দীপনি নাম রাখে দেব অন্তর্যামী।৪৯
পরাশর নাম রাখে ত্রিলোকের স্বাম।।৫০
পদ্মযোনী নাম রাখে অনাদির আদি।৫১
নট-নারায়ন নাম রাখিল সম্বাদি।।৫২
হরেকৃষ্ণ নাম রাখে প্রিয় বলরাম।৫৩
ললিতা রাখিল নাম বাদল-শ্যাম।।৫৪
বিশাখা রাখিল নাম অনঙ্গমোহন।৫৫
সুচিত্রা রাখিল নাম শ্রীবংশীবদন।।৫৬
আয়ন রাখিল নাম ক্রোধ-নিবারণ।৫৭
চন্ডকেশী নাম রাখে কৃতান্ত-শাসন।।৫৮
জ্যোতিষ্ক রাখিল নাম নীলকান্তমণি।৫৯
গোপীকান্ত নাম রাখে সুদাম ঘরণী।।৬০
ভক্তগণ নাম রাখে দেব জগন্নাথ।৬১
দুর্বাসা নাম রাখে অনাথের নাথ।।৬২
রাসেশ্বর নাম রাখে যতেক মালিনী।৬৩
সর্বযজ্ঞেশ্বর নাম রাখেন শিবানী।।৬৪
উদ্ধব রাখিল নাম মিত্র-হিতকারী।৬৫
অক্রুর রাখিল নাম ভব-ভয়হারী।।৬৬
গুঞ্জমালী নাম রাখে নীল-পীতবাস।৬৭
সর্ববেত্তা নাম রাখে দ্বৈপায়ণ ব্যাস।।৬৮
অষ্টসখী নাম রাখে ব্রজের ঈশ্বর।৬৯
সুরলোকে নাম রাখে অখিলের সার।।৭০
বৃষভানু নাম রাখে পরম ঈশ্বর।৭১
স্বর্গবাসী নাম রাখে সর্ব পরাৎপর।।৭২
পুলোমা রাখেন নাম অনাথের সখা।৭৩
রসসিন্ধু নাম রাখে সখী চিত্রলেখা।।৭৪
চিত্ররথ নাম রাখে অরাতি দমন।৭৫
পুলস্ত্য রাখিল নাম নয়ন-রঞ্জন।।৭৬
কশ্যপ রাখেন নাম রাস-রাসেশ্বর।৭৭
ভাণ্ডারীক নাম রাখে পূর্ণ শশধর।।৭৮
সুমালী রাখিল নাম পুরুষ প্রধান।৭৯
পুরঞ্জন নাম রাখে ভক্তগণ প্রাণ।।৮০
রজকিনী নাম রাখে নন্দের দুলাল।৮১
আহ্লাদিনী নাম রাখে ব্রজের গোপাল।।৮২
দেবকী রাখিল নাম নয়নের মণি।৮৩
জ্যোতির্ম্ময় নাম রাখে যাজ্ঞবল্ক্য মুনি।।৮৪
অত্রিমুনি নাম রাখে কোটি চন্দ্রেশ্বর।৮৫
গৌতম রাখিল নাম দেব বিশ্বম্ভর।।৮৬
মরীচি রাখিল নাম অচিন্ত্য-অচ্যুত।৮৭
জ্ঞানাতীত নাম রাখে শৌনকাদিসুখ।।৮৮
রুদ্রগণ নাম রাখে দেব মহাকাল।৮৯
সুরগণ নাম রাখে ঠাকুর দয়াল।।৯০
সিদ্ধগণ নাম রাখে পুতনা-নাশন।৯১
সিদ্ধার্থ রাখিল নাম কপিল তপোধন।।৯২
ভাদুরি রাখিল নাম অগতির গতি।৯৩
মৎস্যগন্ধা নাম রাখে ত্রিলোকের পতি।।৯৪
শুক্রাচার্য্য নাম রাখে অখিল বান্ধব।৯৫
বিষ্ণুলোকে নাম রাখে দেব শ্রীমাধব।।৯৬
যদুগণ নাম রাখে যদুকুলপতি।৯৭
অশ্বিনীকুমার নাম রাখে সৃষ্টি-স্থিতি।।৯৮
অর্য্যমা রাখিল নাম কাল-নিবারণ।৯৯
সত্যবতী নাম রাখে অজ্ঞান-নাশন।।১০০
পদ্মাক্ষ রাখিল নাম ভ্রমরী-ভ্রমর।১০১
ত্রিভঙ্গ রাখিল নাম যত সহচর।।১০২
বংকচন্দ্র নাম রাখে শ্রীরূপমঞ্জরী।১০৩
মাধুরা রাখিল নাম গোপী-মনোহারী।।১০৪
মঞ্জুমালী নাম রাখে অভীষ্টপুরণ।১০৫
কুটিলা রাখিল নাম মদনমোহন।।১০৬
মঞ্জরী রাখিল নাম কর্ম্মব্রহ্ম-নাশ।১০৭
ব্রজব নাম রাখে পূর্ণ অভিলাস।।১০৮
দৈত্যারি দ্বারিকানাথ দারিদ্র-ভঞ্জন।
দয়াময় দ্রৌপদীর লজ্জা-নিবারণ।।
স্বরূপে সবার হয় গোলকেতে স্থিতি।
বৈকুন্ঠে ক্ষীরোদশারী কমলার পতি।।
রসময় রসিক নাগর অনুপম।
নিকুঞ্জবিহারী হরি নবঘনশ্যাম।।
শালগ্রাম দামোদর শ্রীপতি শ্রীধর।
তারকব্রহ্ম সনাতন পরম ঈশ্বর।।
কল্পতরু কমললোচন হৃষীকেশ।
পতিত-পাবন গুরু জ্ঞান-উপদেশ।।
চিন্তামণি চতুর্ভুজ দেব চক্রপাণি।
দীনবন্ধু দেবকী নন্দন যাদুমনি।।
অনন্ত কৃষ্ণের নাম অনন্ত মহিমা।
নারদাদি ব্যাসদেব দিতে নারে সীমা।।
নাম ভজ নাম চিন্ত নাম কর সার।
অনন্ত কৃষ্ণের নাম মহিমা অপার।।
শততার সুবর্ণ গো কোটি কন্যাদান।
তথাপি না হয় কৃষ্ণ নামের সমান।।
যেই নাম সেই কৃষ্ণ ভজ নিষ্ঠা করি।
নামের সহিত আছে আপনি শ্রীহরি।।
শুন শুন ওরে ভাই নাম সংকীর্তন।
যে নাম শ্রবণে হয় পাপ বিমোচন।।
কৃষ্ণনাম হরিনাম বড়ই মধুর।
যেই জন কৃষ্ণ ভজে সে বড় চতুর।।
ব্রহ্ম-আদি দেব যারেঁ ধ্যানে নাহি পায়।
সে ধন বঞ্চিত হলে কি হবে উপায়।।
হিরণ্যকশিপুর উদর-বিদরণ।
প্রহ্লাদে করিল রক্ষা দেব নারায়ণ।।
বলীরে ছলীতে প্রভু হইলা বামন।
দ্রৌপদীর লজ্জা হরি কৈলা নিবারণ।।
অষ্টোত্তর শতনাম যে করে পঠন।
অনায়াসে পায় রাধা কৃষ্ণের চরণ।।
ভক্তবাঞ্ছা পূর্ণকারী নন্দের নন্দন।
মথুরায় কংস-ধ্বংস লঙ্কায় রাবণ।।
বকাসুর বধ আদি কালীয়-দমন।
নরোত্তম কহে এই নাম সংকীর্ত্তণ।                                                        
আজ জন্মাষ্টমি - আসুন শুনে নেই শ্রীকৃষ্ণের কিছু জীবন কাহিনী যদুবংশীয় শূরসেন (বসুদেব) ও তাঁর ভার্যা দেবকীর পুত্র। কৃষ্ণ ছাড়াও কেশব, জনার্দন, বাসুদেব প্রভৃতি তাঁর শতনাম ছিল। কৃষ্ণের সত্যভামা, রুক্মিনী, জাম্ববতী প্রমুখ ষোল হাজার ভার্যা ছিলেন। তাঁর পুত্র-পৌত্রাদির সংখ্যাও অসংখ্য। পত্নী রুক্মিনীর গর্ভজাত পুত্ররা হলেন - সুচারু, চারুবেশ, যশোধর, চারুশ্রবা, চারুদেষ্ণ, প্রদ্যুম্ন ও শম্ভু। জাম্ববতীর গর্ভে শাম্ব জন্মান। পুত্রদের মধ্যে প্রদ্যুম্ন যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছিলেন। কৃষ্ণ ছিলেন বিষ্ণুর অবতার। স্বয়ং নারায়ণ দেবকীর গর্ভে নিজের কৃষ্ণ কেশ নিক্ষেপ করেছিলেন, সেখান থেকেই কৃষ্ণের (কেশব) জন্ম। ধর্মরাজ্য সংস্থাপন ও দুষ্কৃতদের বিনাশ - এই দুই উদ্দেশ্যেই তিনি দেহধারণ করেছিলেন। রাজনীতিজ্ঞ, যোদ্ধা, কর্তব্যপরায়ণ, ধর্মপ্রচারক ও মহাযোগী - এক কথায় কৃষ্ণ ছিলেন আদর্শ পুরুষ। পিতৃস্বসা (পিসীমাতা) কুন্তির তৃতীয় পুত্র অর্জুন (পূর্বজন্মে নর-ঋষি) ছিলেন কৃষ্ণের সখা। অর্থাৎ নরনারায়ণই কৃষ্ণার্জুন হিসেবে মর্ত্তে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সখাত্ব ছাড়াও অর্জুনের সঙ্গে কৃষ্ণের আরেকটি মধুর সম্পর্ক ছিল। অর্জুন কৃষ্ণের বৈমাত্রেয় ভগিনী সুভদ্রাকে বিবাহ করেছিলেন। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান বলে সন্মান করতেন। গুরুত্বপূর্ণ কোনও কাজ শুরু করার আগে তিনি সব সময়ে কৃষ্ণের পরামর্শ নিয়েছেন । রাজসূয়-যজ্ঞের আগে জরসন্ধকে বধ, দুর্যোধনের কাছে অর্ধরাজ্য দাবী করে শান্তির দূত প্রেরণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে সৈন্যাধ্যক্ষ নির্বাচন, মহাযোদ্ধাদের বধের উপায়, ইত্যাদি সর্ব ব্যাপারে কৃষ্ণের উপদেশের ওপরেই যুধিষ্ঠির নির্ভর করেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণ কারোর পক্ষ নিয়েই যুদ্ধ করেন নি, কারণ কৌরব ও পাণ্ডব - উভয়ই ছিলেন ওঁর আত্মীয় - পাণ্ডবরা জন্মসূত্রে, কৌরবরা বৈবাহিক সূত্রে। দুর্যোধনের কন্যা লক্ষণার সঙ্গে কৃষ্ণের পুত্র শাম্বের বিবাহ হয়েছিল। কিন্তু পাণ্ডবদের কল্যাণকেই তিনি জগতের কল্যাণ হিসেবে দেখেছেন। তাই যুদ্ধ না করেও পাণ্ডবদের যাতে জয় হয় সেটাই তাঁর লক্ষ্য ছিল। কাম্যক বনে বনবাসের সময়ে দ্রৌপদী যখন সভাগৃহে দুর্যোধনদের হাতে তাঁর লাঞ্ছনার কথা কৃষ্ণকে জানিয়ে কৃষ্ণের শরণ নিয়েছেন, তখন দ্রৌপদীকে শোক করতে বারণ করে বলেছেন যে, পাণ্ডবদের যাতে কল্যাণ হয়, তাই তিনি করবেন। দ্রৌপদীকে রাজগণের রাণী করবেন বলেও প্রতিজ্ঞা করেছেন। রাজসূয় যজ্ঞের সময়ে মহামতি ভীষ্ম কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ পুরুষ হিসেবে সন্মান দিয়েছেন। কৃষ্ণের সত্য-পরিচয় ভীষ্ম বা বিদুরের অজ্ঞাত ছিল না। দুর্যোধন অন্যপক্ষে কৃষ্ণকে যদু বংশীয় বীর হিসেবেই দেখতেন। তাই কৃষ্ণ যখন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য পাণ্ডবদের হয়ে দৌত্য করতে এলেন, তখন একেলা এসেছেন বলে তাঁকে বন্দী করবার দুর্মতিও দুর্যোধনের হয়েছিল। বিদুরের কাছে কৃষ্ণের ইন্দ্রকে পরাজিত করার কাহিনী, পূতনাবধ, গোবর্ধন-ধারণ, অরিষ্ট-ধেনুক-কংস- শিশুপাল প্রভৃতির নিধনের কথা শুনেও কৃষ্ণকে সম্যক রূপে তিনি চিনতে পারেন নি। কৃষ্ণ যে একা নন, সেটা দুর্যোধনকে বোঝানোর জন্য অট্টহাস্য করতেই কৃষ্ণের মুখের ভেতর থেকে আদিত্য রুদ্র বসুগণ বেরিয়ে এসে তাঁর দেহে অধিষ্ঠান করল, পাণ্ডগণ ও বৃষ্ণ্যন্ধকগণ তাঁকে ঘিরে দাঁড়ালেন। তাঁর সেই ভয়ঙ্কর বিশ্বরূপ দেখে ভীষ্ম, দ্রোণ ও বিদুর ছাড়া আর সবাই ভয়ে চক্ষু মুদ্রিত করলেও দুর্যোধনের তাতে চেতনা হল না। দৌত্য বিফল হল। ফেরার পথে যে-কর্ণ দুর্যোধনের মস্ত বড় সহায় তাঁকে কৃষ্ণ ধরলেন। কৃষ্ণ কর্ণকে তাঁর জন্ম পরিচয় জানিয়ে পাণ্ডবদের দলে যোগ দিতে আহবান করলেন। সেক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব হিসেবে সিংহাসন বসার এবং দ্রৌপদীকে ভার্যা হিসেবে পাবার অধিকার ওঁর থাকবে - সেই প্রলোভনও দেখালেন। কর্ণ রাজি হলেন না, যদিও এই যুদ্ধের ঘোর পরিণাম কৃষ্ণের কথায় তিনি বুঝতে পারলেন। যুদ্ধ না করলেও কুরুক্ষেত্রে কৃষ্ণই পাণ্ডবপক্ষকে চালনা করেছেন। যুদ্ধারম্ভে প্রতিপক্ষে ভীষ্ম, দ্রোণ ও অন্যান গুরুজন এবং বন্ধুবান্ধবদের দেখে অর্জুন যখন বিষাদগ্রস্থ হয়ে ধনুর্বান ত্যাগ করলেন,তখন কর্মযোগ জ্ঞানযোগ ভক্তিযোগের তত্বাবলী শুনিয়ে কৃষ্ণ অর্জুনকে উদ্বুদ্ধ করলেন। অর্জুনকে বিশ্বরূপ প্রদর্শন করে - এই সমস্থ কিছুই যে, ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঘটছে, অর্জুন শুধু তার নিমিত্ত মাত্র - এই গভীর সত্য অর্জুনকে তিনি বুঝিয়েছেন। পাণ্ডবদের জয়ের জন্য তিনি এত উদ্বিগ্ন ছিলেন যে, যুদ্ধের তৃতীয় দিনে ভীষ্ম যখন বিপুল বিক্রমে পাণ্ডব সৈন্য সংহার করছেন, তখন কৃষ্ণ তা সহ্য করতে না পেরে নিজের প্রতিজ্ঞা ভুলে রথ থেকে লাফিয়ে নেমে ভীষ্মকে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে পেরেছেন দেখে ভীষ্মও পরম আনন্দিত হয়েছিলেন। অর্জুনের হস্তক্ষেপে কৃষ্ণ তাঁর সম্বিৎ ফিরে পান। অর্জুন যখন শপথ করেন যে, সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথকে বধ না করতে পারলে তিনি অগ্নিতে প্রাণ বিসর্জন দেবেন, তখন সেই কার্যে অর্জুনকে সফল করতে যোগবলে সূর্যাস্তের একটু আগেই ক্ষণকালের জন্য সূর্যকে তিনি আচ্ছাদিত করেছেন। সূর্যাস্ত হয়েছে ভেবে জয়দ্রথের নিরপত্তা বেষ্টনী একটু শিথিল হতেই জয়দ্রথের সন্মুখীন হয়ে অর্জুন তাঁকে বধ করতে পেরেছেন। দিব্যাস্ত্র দিয়ে জয়দ্রথের শিরশ্ছেদ করে মুণ্ডুটিকে অনেক দূরে তাঁর পিতার কোলে না ফেললে যে অর্জুনের মস্তক শতধা বিদীর্ণ হবে - সে ব্যাপারে অর্জুনকে তিনি সাবধান করেছেন। কর্ণের কাছে যতদিন ইন্দ্রপ্রদত্ত একপুরুষ-ঘাতিনী অস্ত্র ছিল, কৃষ্ণ ততদিন অর্জুনকে নিয়ে কর্ণের সন্মুখীন হন নি। কর্ণ যখন সেই অস্ত্র প্রয়োগ করে ঘটোৎকচকে বধ করতে বাধ্য হলেন, তখন পুত্রহারা পাণ্ডবরা শোকাহত হলেও, কৃষ্ণকে পরিতুষ্ট হতে দেখা গেছে। তার প্রথম কারণ এবার কর্ণকে বধ করা অর্জুনের পক্ষে সম্ভব হবে। দ্বিতীয় কারণ, ভীমের পুত্র হিসেবে পাণ্ডবদের নানান ভাবে সহায়তা করলেও, রাক্ষসীর গর্ভজাত বলে ঘটোৎকচ স্বভাবতই ধর্মদ্বেষী পাপাত্মা। পাপাত্মাদের ধবংস করাই কৃষ্ণের কাজ। কৌরবদের পরাজিত করতে ছলনার আশ্রয় নিতেও কৃষ্ণের কোনও অসুবিধা হয় নি। দ্রোণ যখন অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করছেন, তখন কৃষ্ণই যুধিষ্ঠিরকে ছলনা করে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থমার নিধন বার্তা শোনাতে বলেন। এই কথা শুনলে দ্রোণ অবশ্যই অস্ত্রত্যাগ করবেন - তা তিনি জানতেন। ওঁর সখা অর্জুনও এই পরামর্শে সায় দিতে পারেন নি। তখন কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বুঝিয়েছেন যে, জীবন রক্ষার জন্য মিথ্যা বললে তাতে পাপ হয় না। পিতার মৃত্যুর সংবাদ শুনে অশ্বত্থমা যখন নারায়ণাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন,তখন কৃষ্ণ সবাইকে শস্ত্রত্যাগ করে রথ থেকে নামতে বললেন। কৃষ্ণই শুধু জানতেন যে, এই ভাবেই এই অস্ত্রের হাত থেকে একমাত্র রক্ষা পাওয়া যায়। কর্ণের সঙ্গে অর্জুনের দ্বৈরথ যুদ্ধে অনেক্ষণ যুদ্ধের পর ব্রাহ্মণের প্রদত্ত শাপের জন্য কর্ণের রথের চাকা মাটিতে ঢুকে গেল। চাকা তোলার জন্য কর্ণ অর্জুনের কাছে এক মুহূর্ত সময় চাইলেন। পাছে অর্জুন তাতে রাজি হয়ে যান, সেইজন্য কৃষ্ণ অর্জুনকে বার বার মনে করিয়ে দিলেন দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা, সাত মহারথ মিলে অভিমন্যু বধ, জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার চক্রান্ত - এইসব কথা। কৃষ্ণের উদ্দেশ্য সাধিত হল। অর্জুন জ্বলে উঠে একটা মহাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। পরশুরামের অভিশাপে তাকে প্রতিহত করার কোনও দিব্যাস্ত্র কর্ণের স্মরণে এলো না। তাঁর মস্তক দেহচ্যূত হল। যুদ্ধের শেষে উরুভঙ্গ অবস্থায় মরণাহত দুর্যোধন কৃষ্ণকে কংসের দাসপুত্র বলে সম্বোধন করে, পাণ্ডবদের সমস্থ অন্যায় কর্ম যে কৃষ্ণের ষড়যন্ত্রেই সম্ভব হয়েছে জানিয়ে - স্বধর্মে নিরত কৌরবদের বধ করার জন্য কৃষ্ণকেই দায়ী করেছেন। কৃষ্ণ তাতে বিচলিত না হয়ে উত্তর দিয়েছেন যে, এগুলি সবই দুর্যোধনের দুষ্কার্যের প্রতিশোধ। তারপর বিষাদগ্রস্থ পাণ্ডবদের তিনি বলেছেন যে, শুধু ন্যায়ের পথ নিলে এই যুদ্ধজয় সম্ভব ছিল না বলেই যা করণীয় তা তিনি করতে বলেছেন। দুর্যোধন মরণাপন্ন, কিন্তু অশ্বত্থমা, কৃপ আর কৃতবর্মা বেঁচে আছেন। অশ্বত্থমা গভীর রাত্রে তাঁদের নিয়ে পাণ্ডবশিবিরে ঢুকে কৃষ্ণ ও পাণ্ডবদের অবর্তমানে দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র ও ধৃষ্টদ্যুম, শিখণ্ডী প্রমুখ পাঞ্চালগনকে হত্যা করে পাণ্ডবদের ভয়ে লুকিয়েছেন। পাণ্ডবরা এই দুঃসংবাদ শুনে যখন অশ্বত্থমার সন্মুখীন হলেন,তখন তিনি ভয়ঙ্কর অস্ত্র ব্রহ্মশির পাণ্ডবদের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করলেন। অর্জুন ব্রহ্মশিরকে সংহত করার জন্য নিজেও ব্রহ্মশির নিক্ষেপ করলেন। দুই দিব্যাস্ত্রে প্রায় অগ্নি-প্রলয়ের সৃষ্টি হল। দেবর্ষি নারদ ও ব্যাসদেবের নির্দেশে অর্জুন অস্ত্র সম্বরণ করলেন। অশ্বত্থমা বললেন যে, অস্ত্র প্রত্যাহার করা ওঁর পক্ষে অসাধ্য, সুতরাং তিনি অস্ত্রটি পাণ্ডবদের পুত্রবধূ উত্তরার গর্ভস্থ সন্তানের ওপর নিক্ষেপ করবেন। কৃষ্ণ অশ্বত্থমাকে বললেন যে, অশ্বত্থমা তাতে সফল হবেন না। উত্তরার মৃত পুত্র ভূমিষ্ঠ হবার পর কৃষ্ণ স্বয়ং তাঁকে বাঁচিয়ে তুলবেন। তারপর অশ্বত্থমাকে তিনি কুকর্মের জন্য অভিশাপ দিলেন যে, তিন হাজার বছর ব্যধিগ্রস্থ ও নিঃসঙ্গ হয়ে তাঁকে ঘুরে বেড়াতে হবে। কৃষ্ণের মহিমা আবার দেখা যায় যখন যুদ্ধের শেষে আগে অর্জুনকে তিনি রথ থেকে নামতে বললেন। অর্জুনের পর কৃষ্ণ নামতেই রথ ভস্মসাত্ হয়ে গেল। অর্জুনকে তখন কৃষ্ণ বললেন যে,দ্রোণ আর কর্ণের আগ্নেয়াস্ত্রে রথ আগেই দ±ধ হয়ে গিয়েছিল,কিন্তু কৃষ্ণ বসেছিলেন বলে তা ভস্ম হতে পারে নি। যুধিষ্ঠিরের অনুরোধে পুত্রশোকাতুর ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীকে সান্ত্বনা দেবার জন্য পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণও গিয়েছিলেন। পুত্র-পৌত্রাদির অস্ত্রাঘাত-ছিন্ন মৃতদেহ দর্শনে আর বিধবা বধূদের করুণ বিলাপে গান্ধারী নিজেও স্থির রাখতে পারছিলেন না। কৃষ্ণকে বললেন যে, কৃষ্ণ অসীম ক্ষমতাধারী হয়েও, কেন কুরুকুলের এই ক্ষয় হতে দিলেন! তারপর কৃষ্ণকে অভিশাপ দিলেন যে, পঁয়ত্রিশ বছর পরে কৃষ্ণের জ্ঞাতিগণও পরস্পর হানাহানি করে নির্মূল হবে। কৃষ্ণ নিজেও সবাইকে হারিয়ে একা বনে বনে ভ্রমণ করে অবশেষে নিহত হবেন। কৃষ্ণ তার উত্তরে বলেছিলেন, এটা যে ঘটবে সেটা তাঁর অজানা নয়। যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধ-যজ্ঞ শেষ হবার পর কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরে যাবার পর যাদবদের মধ্যে হানাহানি শুরু হল। কৃষ্ণ সবাইকে তীর্থযাত্রা করে সমুদ্রতীরে যাবার নির্দেশ দিলেন। প্রভাস-তীর্থে যাদবরা মদ্যপানে মত্ত হয়ে হানাহানি করে সবই নিহত হল। অর্জুনকে খবর পাঠিয়ে, অর্জুন না আসা পর্যন্ত পিতা বসুদেবের ওপরে যাদবনারীদের রক্ষার ভার দিয়ে, কৃষ্ণ বলরামের খোঁজে গেলেন। গিয়ে দেখলেন যোগযুক্ত অবস্থায় বলরাম দেহত্যাগ করছেন। বলরামের দেহত্যাগের পর কৃষ্ণ গভীর অরণ্যে বসে যোগালম্বন করলেন। বহুবছর আগে মহর্ষি দুর্বাসা তাঁর উচ্ছিষ্ট পায়েস কৃষ্ণকে সর্বাঙ্গে লেপন করতে আদেশ দিলে, কৃষ্ণ পদতল ব্যতীত সবস্থানেই তা লেপন করেছিলেন। তাই দেখে দুর্বাসা বলেছিলেন যে, পদতলে আহত হয়েই কৃষ্ণ দেহত্যাগ করবেন। গান্ধারী বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যু হবে যখন তিনি একাকি অরণ্যে থাকবেন। তাই সত্য হল। জরা নামে এক ব্যাধ হরিণ ভ্রমে কৃষ্ণের পদতলে বাণ নিক্ষেপ করলেন। সেই ব্যধ যখন অপরাধ বুঝতে পারলেন, তখন কৃষ্ণ উর্ধলোকে যাত্রা করছেন।                                        সবাইকে জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা আজ জন্মাষ্টমি - দুর্ভাগ্য বশত আজ আমাদের সরকারী ছুটি আগামী কালকে দেয়া হয়েছে -এই কারনে আমরা অনেকেই জন্মাষ্টমির র‍্যালিতে যেতে পারবোনা - কিন্তু এই সাইটে থেকেও তো এই জন্মাষ্টমী পালন করা যায়- এই চিন্তা থেকে এখন এখানে দেয়া হল ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনেক গুলো ওয়াল পেপার- নিন একগাদা জন্মাষ্টমির শুভেচ্ছা সহ শ্রীকৃষ্ণের ছবি












































ধন্যবাদ সবাইকে
হরে কৃষ্ণ                                 
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত //////////১দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮২, ৫ই অগস্ট

বিদ্যাসাগর

সিঁড়ি দিয়া উঠিয়া একেবারে প্রথম কামরাটিতে (উঠিবার পর ঠিক উত্তরের কামরাটিতে) ঠাকুর ভক্তগণসঙ্গে প্রবেশ করিতেছেন। বিদ্যাসাগর কামরার উত্তরপার্শ্বে দক্ষিণাস্য হইয়া বসিয়া আছেন; সম্মুখে একটি চারকোণা লম্বা পালিশ করা টেবিল। টেবিলের পূর্বধারে একখানি পেছন দিকে হেলান-দেওয়া বেঞ্চ। টেবিলের দক্ষিণপার্শ্বে ও পশ্চিমপার্শ্বে কয়েকখানি চেয়ার। বিদ্যাসাগর দু-একটি বন্ধুর সহিত কথা কহিতেছিলেন।

ঠাকুর প্রবেশ করিলে পর বিদ্যাসাগর দণ্ডায়মান হইয়া অভ্যর্থনা করিলেন। ঠাকুর পশ্চিমাস্য, টেবিলের পূর্বপার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন। বামহস্ত টেবিলের উপর। পশ্চাতে বেঞ্চখানি। বিদ্যাসাগরকে পূর্বপরিচিতের ন্যায় একদৃষ্টে দেখিতেছেন ও ভাবে হাসিতেছেন।

বিদ্যাসাগরের বয়স আন্দাজ ৬২/৬৩। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অপেক্ষা ১৬/১৭ বৎসর বড় হইবেন। পরনে থান কাপড়, পায়ে চটি জুࢤা, গায়ে একটি হাত-কাটা ফ্লানেলের জামা। মাথার চতুষ্পার্শ্ব উড়িষ্যাবাসীদের মতো কামানো। কথা কহিবার সময় দাঁতগুলি উজ্জ্বল দেখিতে পাওয়া যায়, — দাঁতগুলি সমস্ত বাঁধানো। মাথাটি খুব বড়। উন্নত ললাট ও একটু খর্বাকৃতি। ব্রাহ্মণ — তাই গলায় উপবীত।

বিদ্যাসাগরের অনেক গুণ। প্রথম — বিদ্যানুরাগ। একদিন মাস্টারের কাছে এই বলতে বলতে সত্য সত্য কেঁদেছিলেন, “আমার তো খুব ইচ্ছা ছিল যে, পড়াশুনা করি, কিন্তু কই তা হল! সংসারে পড়ে কিছুই সময় পেলাম না।” দ্বিতীয় — দয়া সর্বজীবে, বিদ্যাসাগর দয়ার সাগর। বাছুরেরা মায়ের দুধ পায় না দেখিয়া নিজে কয়েক বৎসর ধরিয়া দুধ খাওয়া বন্ধ করিয়াছিলেন, শেষে শরীর অতিশয় অসুস্থ হওয়াতে অনেকদিন পরে আবার ধরিয়াছিলেন। গাড়িতে চড়িতেন না — ঘোড়া নিজের কষ্ট বলিতে পারে না। একদিন দেখলেন, একটি মুটে কলেরা রোগে আক্রান্ত হইয়া রাস্তায় পড়িয়া আছে, কাছে ঝাঁকাটা পড়িয়া অছে। দেখিয়া নিজে কোলে করিয়া তাহাকে বাড়িতে আনিলেন ও সেবা করিতে লাগিলেন। তৃতীয় — স্বাধীনতাপ্রিয়তা। কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে একমত না হওয়াতে, সংস্কৃত কলেজের প্রধান অধ্যক্ষের (প্রিন্সিপালের) কাজ ছাড়িয়া দিলেন। চতুর্থ — লোকাপেক্ষা করিতেন না। একটি শিক্ষককে ভালবাসিতেন; তাঁহার কন্যার বিবাহের সময়ে নিজে আইবুড়ো ভাতের কাপড় বগলে করে এসে উপস্থিত। পঞ্চম — মাতৃভক্তি ও মনের বল। মা বলিয়াছেন, ঈশ্বর তুমি যদি এই বিবাহে (ভ্রাতার বিবাহে) না আস তাহলে আমার ভারী মন খারাপ হবে, তাই কলিকাতা হইতে হাঁটিয়া গেলেন। পথে দামোদর নদী, নৌকা নাই, সাঁতার দিয়া পার হইয়া গেলেন। সেই ভিজা কাপড়ে বিবাহ রাত্রেই বীরসিংহায় মার কাছে গিয়া উপস্থিত! বলিলেন, মা, এসেছি!

শ্রীরামকৃষ্ণকে বিদ্যাসাগরের পূজা ও সম্ভাষণ

ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন ও কিয়ৎক্ষণ ভাবে দাঁড়াইয়া আছেন। ভাব সংবরণ করিবার জন্য মধ্যে মধ্যে বলিতেছেন, জল খাব। দেখিতে দেখিতে বাড়ির ছেলেরা ও আত্মীয় বন্ধুরা আসিয়া দাঁড়াইলেন।

ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইয়া বেঞ্চের উপর বসিতেছেন। একটি ১৭/১৮ বছরের ছেলে সেই বেঞ্চে বসিয়া আছে — বিদ্যাসাগরের কাছে পড়াশুনার সাহায্য প্রার্থনা করিতে আসিয়াছে। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট, ঋষির অর্ন্তদৃষ্টি; ছেলের অন্তরের ভাব সব বুঝিয়াছেন। একটু সরিয়া বসিলেন ও ভাবে বলিতেছেন, “মা! এ-ছেলের বড় সংসারাসক্তি! তোমার অবিদ্যার সংসার! এ অবিদ্যার ছেলে!”

যে-ব্যক্তি ব্রহ্মবিদ্যার জন্য ব্যাকুল নয়, শুধু অর্থকরী বিদ্যা উপার্জন তাহার পক্ষে বিড়ম্বনা মাত্র, এই কথা কি ঠাকুর বলিতেছেন?

বিদ্যাসাগর ব্যস্ত হইয়া একজনকে জল আনিতে বলিলেন ও মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন, কিছু খাবার আনিলে ইনি খাবেন কি? তিনি বলিলেন, আজ্ঞা, আনুন না। বিদ্যাসাগর ব্যস্ত হইয়া ভিতরে গিয়া কতকগুলি মিঠাই আনিলেন ও বলিলেন, এগুলি বর্ধমান থেকে এসেছে। ঠাকুরকে কিছু খাইতে দেওয়া হইল, হাজরা ও ভবনাথও কিছু পাইলেন। মাস্টারকে দিতে আসিলে পর বিদ্যাসাগর বলিলেন, “ও ঘরের ছেলে, ওর জন্য আটকাচ্ছে না।” ঠাকুর একটি ভক্তছেলের কথা বিদ্যাসাগরকে বলিতেছেন। সে ছোকরাটি এখানে ঠাকুরের সম্মুখে বসে ছিল। ঠাকুর বলিলেন, “এ-ছেলেটি বেশ সৎ, আর অন্তঃসার যেমন ফল্গুনদী, উপরে বালি, একটু খুঁড়লেই ভিতরে জল বইছে দেখা যায়!”

মিষ্টিমুখের পর ঠাকুর সহাস্যে বিদ্যাসাগরের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। দেখিতে দেখিতে একঘর লোক হইয়াছে, কেহ উপবিষ্ট, কেহ দাঁড়াইয়া।

শ্রীরামকৃষ্ণ — আজ সাগরে এসে মিললাম। এতদিন খাল বিল হদ্দ নদী দেখেছি, এইবার সাগর দেখছি। (সকলের হাস্য)

বিদ্যাসাগর (সহাস্যে) — তবে নোনা জল খানিকটা নিয়ে যান! (হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ — না গো! নোনা জল কেন? তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও, তুমি যে বিদ্যার সাগর! (সকলের হাস্য) তুমি ক্ষীরসমুদ্র! (সকলের হাস্য)

বিদ্যাসাগর — তা বলতে পারেন বটে।

বিদ্যাসাগর চুপ করিয়া রহিলেন। ঠাকুর কথা কহিতেছেন —

বিদ্যাসাগরের সাত্ত্বিক কর্ম — “তুমিও সিদ্ধপুরুষ”

“তোমার কর্ম সাত্ত্বিক কর্ম। সত্ত্বের রজঃ। সত্ত্বগুণ থেকে দয়া হয়। দয়ার জন্য যে কর্ম করা যায়, সে রাজসিক কর্ম বটে — কিন্তু এ রজোগুণ — সত্ত্বের রজোগুণ, এতে দোষ নাই। শুকদেবাদি লোকশিক্ষার জন্য দয়া রেখেছিলেন — ঈশ্বর-বিষয় শিক্ষা দিবার জন্য। তুমি বিদ্যাদান অন্নদান করছ, এও ভাল। নিষ্কাম করতে পারলেই এতে ভগবান-লাভ হয়। কেউ করে নামের জন্য, পুণ্যের জন্য, তাদের কর্ম নিষ্কাম নয়। আর সিদ্ধ তো তুমি আছই।”

বিদ্যাসাগর — মহাশয়, কেমন করে?

শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্য) — আলু পটল সিদ্ধ হলে তো নরম হয়, তা তুমি তো খুব নরম। তোমার অত দয়া! (হাস্য)

বিদ্যাসাগর (সহাস্য) — কলাই বাটা সিদ্ধ তো শক্তই হয়! (সকলের হাস্য)

শ্রীরামকৃষ্ণ — তুমি তা নও গো; শুধু পণ্ডিতগুলো দরকচা পড়া! না এদিক, না ওদিক। শকুনি খুব উঁচুতে উঠে, তার নজর ভাগাড়ে। যারা শুধু পণ্ডিত শুনতেই পণ্ডিত, কিন্তু তাদের কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তি — শকুনির মতো পচা মড়া খুঁজছে। আসক্তি অবিদ্যার সংসারে। দয়া, ভক্তি, বৈরাগ্য বিদ্যার ঐশ্বর্য।

বিদ্যাসাগর চুপ করিয়া শুনিতেছেন। সকলেই একদৃষ্টে এই আনন্দময় পুরুষকে দর্শন ও তাঁহার কথামৃত পান করিতেছেন।
পুতুলের মতো সাজানো হয়েছে বাড়িটাকে আজ। বাহারি ফুল, রঙিন কাপড় ও কাগজের সমাহার পুরো বাড়ি জুড়ে।তার উপর রং বেরংয়ের মরিচা বাতি গুলো প্রজ্জলিত হচ্ছে সারা বাড়িময়। তারা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে বিরামহীন চঞ্চলতা নিয়ে।আমার মনের ভাবনা গুলিও যেন এই মরিচা বাতিদের সাথে খেলা করার ব্যার্থ প্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু হয়তো কুলিয়ে উঠতে পারছেনা। এক নিদারুণ জড়তা জমেছে আমার মনের ভাবনা গুলোতে। বলা যায় কেউ একজন অসীম জড়তা নিয়ে আটকে রয়েছে এই হৃদয়ে। যে জড়তা কখনো ছুটবার নয়। হয়তো ইচ্ছে করেই পুষে চলেছি তাদের এক অজানা মায়ায়।

আজ আমার বাসর রাত। বর হিসেবে এখন বাসর রাত পালন করার কথা থাকলেও নিজের রুমে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা করছে না আমার।নতুন বউকে খাটের উপর বসিয়ে রেখেই বারান্দায় এসে সিগারেটের পর সিগারেট টানছি। জ্বলন্ত সিগারেটের কুন্ডলীতে ভষ্মীভূত করতে চাইছি অতীত কষ্ট ও দুঃস্মৃতি গুলিকে। কিন্তু তার বদলে সেই কুন্ডলীতেই প্রতিভাত হচ্ছে নিজের সোনালী ভবিষ্যতের অগ্নিদাগ্ধ রূপ।

কিছুটা জোর করেই বিয়েটা করানো হয়েছে আমাকে। একে তো বাবার আদেশ তার উপরে মায়ের অশ্রুসিক্ত নয়নের আবদার,

"দেখ ঈষাম,তুই ই আমাদের একমাত্র সন্তান। নিজের জীবনটা এভাবে নষ্ট করিস না। তোর যদি কিছু হয় তাহলে এই বুড়ো বাবা মায়ের কি হবে এইটা একটু ভেবে দেখ! এবার একটা বিয়ে কর বাবা। নিজের জীবনটাকে গুছিয়ে নে!"

তাদের বারবার এমন প্রস্তাব উপেক্ষা করতে না পেরেই বিয়েটা করা। মায়ের মতে আমার নতুন বউ নাকি খুবই রূপসী এবং সুশীল পরিবারের মেয়ে। কিন্তু তাতে আমার কি!! আমার কিছু যায় আসেনা। এখন পর্যন্ত মেয়েটির ছবিও দেখিনি। দেখার কোন ইচ্ছাও নেই!! বিয়ে যেহেতু বাবা-মায়ের কথায় করছি তাই তাদের পছন্দ হলেই হলো। আর যার সাথে কখনো আমার হৃদয়ের সম্পর্ক হবার নয় তাকে দেখেই বা কি লাভ!!

বারান্ডায় প্রচন্ড বাতাস হচ্ছে। হঠাত্‍ বাতাসে ভেসে হাড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করছে ৫ বছর পূর্বের সেই ভার্সিটি জীবনে। বারবার মনের দৃশ্যপটে ঊকি দিচ্ছে সেই আবেগঘন দিনের স্মৃতি গুলি। যেদিন প্রথমবার দেখা হয়েছিল তার সাথে।

ক্যাফেটেরিয়ার এক কোণায় একলা টেবিলে কফির মগ হাতে নিয়ে বসে ছিল মেয়েটি। লাল জামা এবং খোলা চুলে তাকে ঠিক এক ডানা কাঁটা পরীর মতো লাগছিল। সেদিন জীবনে প্রথম কোন মেয়েকে দেখে হৃদয়ের স্পন্দন গতিটা হঠাত্‍ করে বেড়ে গিয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল এই অপ্সরীর জন্যেই আমার পৃথিবীতে আসা। তাকে ছাড়া এই জীবন অচল, নিছক অর্থহীন।


কিছুদিনের মাঝেই আমার এক বন্ধুর কল্যানেই পরিচয় হয় তার সাথে।তার ডিপার্টমেন্টের ছাত্রী ছিল মেয়েটি। সেদিনই আমি প্রথম জানতে পেরেছিলাম তার নাম।

'নীরা'

এই নামটি যেন আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল চিরদিনের জন্য।

সেদিনের পর প্রতিদিনই দেখা হতো আমাদের। আমাদের সম্পর্কটা এক সময় আপনি থেকে তুমি গড়িয়ে তুই এ রুপান্তরিত হয়। একে অপরকে ছাড়া একটি মুহূর্ত ও থাকতে পারতাম না আমরা। আমাদের বন্ধুত্ব সারা ভার্সিটি জুড়ে ঈর্ষার কারন হয়ে দাড়িয়েছিল। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করার সময় কোথায় আমাদের। আমরা আমাদের বন্ধুত্বটা ঠিকই বহাল রেখেছিলাম ভার্সিটির শেষ দিনটি পর্যন্ত।

নীরাকে প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকেই তার উপর দুর্বল হয়ে পরেছিলাম আমি। তাকে বন্ধু থেকে কিছুটা বেশিই ভাবতাম সব সময়। যতক্ষণ তার সাথে থাকতাম এক ধরণের অজানা ভাল লাগা কাজ করতো আমার মাঝে। তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ মন্ত্র মুগ্ধের মতো শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতাম আমি। এক
অটুট বাঁধনে আটকা পড়েছিলাম এই মেয়েটিকে ঘিরে। হয়তো একেই বলে ভালবাসার বাঁধন।

নীরাকে হৃদয় ঊজার করে ভালবাসলেও মুখ ফোঁটে কখনো বলা হয়নি তাকে নিজের হৃদয়ের অনুভূতি গুলি। অনেক ভয় হতো। ভালবাসার প্রকাশ করতে গিয়ে যদি পরিশেষে এই বন্ধুত্বটাও হাড়াতে হয়!! এই ভেবে সর্বদাই এক পা এগিয়ে দুই পা পিছিয়ে যেতাম।

আমাদের ভার্সিটি জীবনের পরেও মাঝে মাঝে দেখা করতাম আমরা। তেমনি একদিন নীরার ফোন আসে দেখা করার জন্যে। ফোনে বলেছিল একটা খুশির সংবাদ দিবে আমাকে।

ভাবলাম এইটাই সুযোগ তাকে আমার হৃদয়ে গোপন করে রাখা না বলা ভালবাসার কথাটি বলে দেয়ার।তার প্রিয় এক মুঠো লাল গোলাপ নিয়ে গেলাম সেদিন বুক ভরা প্রত্যাশা নিয়ে।এই প্রত্যাশা ভালবাসার,ভালবাসার মানুষটিকে একান্তভাবে কাছে পাবার।

কিন্তু তার দেয়া বিয়ের কার্ডটি হাতে নিয়ে আর ভালবাসার কথাটি বলা হলো না আমার। কিছুদিন পরেই তার বিয়ে আর এটিই ছিল তার বলা সেই খুশির সংবাদ। যা খুশির বদলে দুঃখের বিষ মাখা এক সূচালো তীর হয়ে বিঁধেছিল আমার হৃদয়ের ঠিক মাঝখানটায়। যে লাল গোলাপ নিয়ে নিজের ভালবাসার ফুল ফোটাতে চেয়েছিলাম সেই লাল গোলাপ দিয়েই তার নতুন জীবনের শুভেচ্ছা প্রদান করে ফিরে আসলাম। এটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা। আমার প্রথম এবং একমাত্র ভালবাসার করুণ পরিসমাপ্তি।বারান্দায় বসে থাকতে আর ভাল লাগছে না। চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে। হাতের শেষ সিগারেটটা শেষ করেই রুমের ভেতরে যাই আমি। মাথার ঘুমটা না উঠিয়েই খাটের উপর জড়সড় হয়ে হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে আমার নতুন বউ। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে তার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকি। মেয়েটার জন্যে একটু করুনার জন্ম নেয় মনের কোণে। একটা মেয়ে বিয়ের প্রথম রাতটির জন্যে কতো শত আবেগমাখা স্বপ্ন বুনে রাখে মনের ভেতর বছরের পর বছর জুরে। এই মেয়েটিও হয়তো তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু আমি এক নিমিষেই ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছি তার সকল রঙ্গিন স্বপ্ন। নিজের কাছেই এখন নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে খুব।

নিঃশব্দে খাটের কাছে যাই আমি। তার গায়ের উপর কাঁথা জড়িয়ে দিয়ে নিজের বালিশটা নিয়ে সোফায় এসে ঘুমিয়ে পড়ি সাথে সাথেই।


চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম ভাঙ্গে আমার। হাত ঘড়িটাতে চোখ পড়তেই দেখি ১০.১৫ মি.। কখনো এতো দেড়ী করে ঘুম থেকে উঠিনা আমি।হয়তো কাল অনেক রাত করে ঘুমানোর ফল এইটা। সোফার সামনে টেবিলে এক মগ গরম কফি রাখা। তার পাশে আমাদের বিয়ের কার্ড। ডান হাতে কফির মগ হাতে নিয়ে বাম হাতে কার্ডটি খুলি আমি।

কনের নামের জায়গায় লিখা-

"সাদিয়া মেহজাবিন নদী"

নামটা অনেকটা হৃদয়ে গেঁথে যায় আমার। মনে হলো যেন তিনটি সুন্দর নামকে একত্রিত করে একটি নাম বানানো হয়েছে।

এরই মাঝে মাথায় ঘোমটা দিয়েই ঘরে প্রবেশ করে নদী। সোফাতে বসেই তার দিকে চোখ তুলি। কিন্তু সেই চোখ আর সরাতে পারি নি কিছুতেই। এতো স্নিগ্ধ এবং কোমল চেহারার মেয়ে আমি হয়তো জীবনে প্রথম দেখলাম।তার কাজল টানা চোখ গুলি ঝিলের জলের
মতো স্বচ্ছ। যেন এখনই টুপ করে ডুব দিয়ে সাতার কাঁটা যাবে। তার উপর পড়নের লাল শাড়িটা তার সৌন্দর্যটা বাড়িয়ে দিয়েছিল শতগুণে।

ভেবেছিলাম কাল রাতের কথা নিশ্চই জিজ্ঞেস করবে আমাকে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ঐ ব্যাপারে একটা প্রশ্ন ও করেনি সে।

এভাবেই কাটছিলো আমার দিন গুলি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অফিসে চলে যেতাম এবং ফিরতাম অনেক রাত করে।নদীর সাথে খুবই কম সময় কাঁটাতাম আমি।তার স্নিগ্ধতা ও সৌন্দর্য্য আমাকে আকৃষ্ট করতো প্রতিনিয়ত। কিন্তু এক ধরনের বাঁধা কাজ করতো আমাদের মাঝে। যে বাঁধার কারণে সব আকর্ষণ ছিন্ন করে দিতো আমার। দূরে ঠেলে দিতো তার কাছ থেকে যোজন যোজন পথ।

নদীকে আমি ভালবাসা দিতে না পারলেও তার পক্ষ থেকে কখনো কোন আক্ষেপই শুনিনি,, ছিলোনা কোন আবদারও। আমার ঐ দূরত্ব ও নির্লিপ্ততাকে গ্রহণ করে সংসার করে চলেছিলো সে অনায়াসেই। হয়তো মেয়েদের একটা আলাদা শক্তি থাকে। যা দিয়ে তারা নিরঙ্কুশভাবে ভালবাসা বিলিয়ে যেতে পারে কোন প্রকার প্রতিদানের আশা ছাড়াই।

প্রায় চার মাসের মতো হয়ে গেলো আমাদের বিয়ের। মায়ের কথায় নদীকে তার বাবার বাড়ীতে নিয়ে চললাম আমি। বিয়ের পর এই প্রথম আমি তাকে নিয়ে বেড় হই।

ঢাকার ব্যাস্ত রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম আমি এবং আমার পাশে নিশ্চুপ মেয়ে হয়ে বসে আছে নদী। গাড়ির জানালা দিয়ে প্রবেশ করা বাতাসে তার খোলা চুলগুলি বারবার সরে আসছিলো আমার দিকে। আড় চোখে আমি তার দিকে তাকাচ্ছিলাম এবং মুগ্ধ হচ্ছিলাম তার সৌন্দর্য্যে। এরই মাঝে সিগনাল পরে রাস্তায়। গাড়ি থামিয়ে তার দিকে তাকাই আমি। বাইরে ফুলের দোকানের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটি।

সেদিকে তাকাতেই দেখলাম অনেক গুলো লাল গোলাপ সাজিয়ে রাখা হয়েছে পুরো দোকান জুড়ে। হয়তো মন চাইছে সেই গোলাপ গুলিকে ছুঁয়ে দেখতে,তাদের স্নিগ্ধতার পরশ নিতে। কিন্তু আমি জানি মুখ ফুঁটে আমাকে কখনোই কিছু বলবে না এই মেয়েটা। নিজের সব চাওয়া পাওয়া গুলোকে নিজের মাঝেই বন্ধি করে রাখে সে। কিন্তু যখনি আমি নিজের থেকে কিছু একটা দেই তখন বাচ্চাদের মতো উচ্ছাসিত হয়ে উঠে। চোখে মুখে ফুঁটে উঠে প্রাপ্তির অনাবিল আনন্দ রেখা।

হঠাত্‍ কি যেন হলো আমার। এক দৌড়ে চলে গেলাম রাস্তার বিপরীত পাশে ফুলের দোকানটায়। খুব জলদি এক মুঠো লাল গোলাপ হাতে নিয়েই পা বাড়ালাম গাড়ির দিকে।এরই মাঝে সিগনাল ভাঙ্গলো রাস্তার। গাড়ির কাছাকাছি চলে আসতেই হঠাত্‍ সো সো শব্দ করে একটি বাস চলে গেলো ঠিক চোখের কয়েক ইঞ্চি সামনে দিয়ে। কিছু বোঝে উঠার আগেই এক চিত্‍কার দিয়ে নদী এসে ঝাপিয়ে পড়লো বুকে। তার চোখের পানিতে ভিজতে শুরু করলো আমার সাদা শার্ট। নিজের অজান্তেই দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম নদীকে। মনে হলো যেনো মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে সদ্য জয় করে নিলাম এক নতুন জীবন। ভালবাসাময় নতুন জীবন.....


No comments:

Post a Comment

Google

Note: Only a member of this blog may post a comment.

adonion